কখন হেলথ চেকআপ করাবেন— প্রশ্নগুলোর সোজাসুজি কোনও উত্তর হয় না। তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে বেশ কতকগুলো বিষয় মাথায় রাখুন। এতে হেলথ চেকআপ করানো উচিত নাকি অনুচিত সেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। টেস্টগুলি করানো আসলে কতকগুলি শর্তের ওপর নির্ভর করে।
শর্ত ১: শরীরে কোনও বিশেষ ধরনের অস্বস্তিকর উপসর্গ দেখা দিচ্ছে।
শর্ত ২: কোনও কোনও পরিবারে কিছু কিছু অসুখ হওয়ার পারিবারিক ইতিহাস থাকে। যেমন সুগার, কোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি। এই ধরনের সমস্যা থাকলে ২০ বছর বয়স হওয়া মাত্র কতকগুলি নির্দিষ্ট টেস্ট করানো দরকার।
শর্ত ৩: পারিবারিক ইতিহাস থাকুক বা নাই থাকুক, ২৫ বছর বয়স হওয়া মাত্র প্রত্যেকের উচিত অন্তত একবার সাধারণ কতকগুলি স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলি করা।
শর্ত ৪: বিয়ের আগে বেশ কতকগুলি জরুরি পরীক্ষা করাতেই হবে।
এই আলোচনা যেহেতু সবার জন্যই, তাই যে টেস্টগুলি সবাই করাতে পারবেন, সেই টেস্টগুলি সম্পর্কে জানানো হল।
ব্লাড গ্রুপ: বর্তমান সময়ে প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করা। রক্তের গ্রুপ জানা থাকলে, অসুস্থ মানুষের রক্ত দরকার পড়লে রক্ত সংগ্রহ করতে সময় কম লাগে। চিকিৎসক সঠিক সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
ব্লাড সুগার: কোনও উপসর্গ থাকুক আর আর নাই থাকুক, ২৫ বছর বয়সের পরে ব্লাড সুগার টেস্ট করা একান্ত প্রয়োজনীয়। কারণ যে কোনও বয়সের লোকের সুগার ধরা পড়ছে নতুন করে। ডায়াবেটিস থাকলে গ্লুকোমা, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির পরীক্ষা প্রতিবছর করান।
থাইরয়েড: উপসর্গ আর রোগের পারিবারিক ইতিহাস না থাকলেও ২৫ বছর বয়সের পর টি এস এইচ পরীক্ষা করান।
ব্লাড কোলেস্টেরল: সমস্যা হল রক্তে কোলেস্টেরল বাড়লে আলাদাভাবে শারীরিক কোনও লক্ষণ ফুটে ওঠে না। তাই ২৫ বছর বয়সে এবং এর পরে অতিতঅবশ্যই প্রতিবছর রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা মাপুন। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা জানার জন্য পরীক্ষাটির নাম লিপিড প্রোফাইল। এল ডি এল (খারাপ কোলেস্টেরল), এইচ ডি এল (ভালো কোলেস্ট্রল), ট্রাইগ্লিসারাইডস (খারাপ লিপিড) এবং টোটাল কোলেস্টেরলের মাত্রা জানা যায়।
হিমোগ্লোবিন: রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি আছে কি না তা জানতে এই পরীক্ষা করা হয়। প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা থাকে সাধারণত ১৩ থেকে ১৫ গ্রাম। এর নিচে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নেমে গেলে অ্যানিমিয়া হয়। অ্যানিমিয়া আছে কিনা জানতে প্রধানত দু’ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। পেরিফেরাল ব্লাডস্মিয়ার ও কমপ্লিট হিমোগ্রাম। এছাড়াও চিকিৎসক প্রয়োজন বুঝে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস, এইচ পি এল সি পরীক্ষা করাতে দেন।
লিপিড প্রোফাইল: বছরে অন্তত একবার লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করান উচিত।
ইউরিন টেস্ট: ইউরিন বেরনোর জ্বালা যন্ত্রণা, তলপেটে ব্যথা দেখা দিলে রুটিন ইউরিন টেস্ট এবং ইউরিন কালচার করান।
থ্যালাসেমিয়া: ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য চেহারা, খিটখিটে মেজাজ, প্রবল দুর্বলতা, খিদে না পাওয়া, ঘন ঘন সর্দি-কাশির সমস্যা অ্যানিমিয়ার সমস্যা নির্দেশ করে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকরা রোগীকে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্টের সঙ্গে রেটিকুলোসাইট কাউন্ট- এই টেস্ট করতে দেন। টেস্ট রিপোর্টে লোহিত রক্তকণিকার আকারের সম্পর্কে লেখা থাকে। সেটা দেখে চিকিৎসক ধারণা করতে পারেন রোগী থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি না। নিশ্চিত হতে আরও একটি রক্তপরীক্ষা করতে হয়, যার নাম হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস।
ব্লাড প্রেসার: প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক রক্তচাপ হল ১২০ (উপরে)/৮০ (নিচে)। ওপরের অংশে রক্তচাপ ১২০ মাত্রার নিচে চলে গেলে তাকে লো-প্রেশার বলে। অন্যদিকে নিচের অংশে ৮০ মাত্রার বেশি রক্তচাপ হলে তাকে হাই প্রেসার বলে। যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এই মাত্রার সামান্য হেরফের হয়। তবে তা চিকিৎসকের বোঝার বিষয়। সাধারণ ভাবে ১২০/৮০ মাত্রাটি জানলেই চলে।রক্তচাপের হেরফের ঘটলে ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরা, বুকে ব্যথা, অল্পেই মেজাজ হারিয়ে ফেলা, শরীরে অব্দস্তি, দুর্বলতা, হাঁপ ধরার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ব্লাড প্রেসার মাপার নিয়ম হল একই সপ্তাহে দু’বার রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে। প্রেসার টেস্ট করার আগে কোনওভাবেই চা, কফি, সিগারেট বা কোনও ধরনের নেশার দ্রব্য সেবন করা চলবে না। ১৫ মিনিট স্থির হয়ে বসে তারপর ব্লাডপ্রেসার মাপতে হবে।
ব্লাড প্রেসারের রিপোর্টে সমস্যা ধরা পড়লে বেশ কিছু পরীক্ষা করতে হয়। কারণ রক্তচাপ বেশি থাকলে কিডনি, চোখ, হার্ট, ব্রেনে বহু সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ব্লাড সুগার, ব্লাড কোলেস্টেরল, ক্রিয়েটিনিন, স্পট অ্যালবুমিন ক্রিয়েটিনিন রেশিও (ইউরিন যদর এ সি আর), ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, অপথ্যালমোস্কোপের মতো বেশ কিছু পরীক্ষা করে নিলে ভালো।
এইডস: সুস্থ মানুষ এইডস রোগে আক্রান্ত হলে তার স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন জটিল অসুখ শরীরে হামলা করে। পাঁচ বছর অন্তর এইচ আই ভি টেস্ট প্রত্যেক মানুষের বাধ্যতামূলকভাবে করা উচিত। কারণ এটি অসুরক্ষিত ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক এবং রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এইচ আই ভি টেস্ট করা থাকলে নিজে যেমন সুরক্ষিত থাকা যায় তেমনই অন্যকেও সুরক্ষিত রাখা যায়।
হেপাটাইটিস: এইডসের মতো হেপাটাইটিস বি. সি. ডি অসুরক্ষিত শারীরিক সম্পর্ক, দেহরসের মাধ্যমে রোগী থেকে সুস্থ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর এত ধীরে ধীরে রোগটি শরীরকে বিকল করে দেয় যে, লক্ষণ বোঝার আগেই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। তাই ৫ বছর অন্তর এই রক্তপরীক্ষা প্রত্যেকের করা আবশ্যক।
আরও কিছু পরীক্ষা-
লিভার ফাংশন টেস্ট এবং রক্তের ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিন ৪০ বছর বয়সের পর রুটিন চেক করালে ভালো হয়। কারণ এতে জন্ডিস সহ ফ্যাটি লিভারের সমস্যা থাকলে ধরা পড়ে যায়। আর ‘ইউরিয়া রুটিন টেস্ট’ ৪০ বছর বয়সের পর করান। এতে ইউরিনে প্রোটিন বেরচ্ছে কিনা তা যেমন পরিষ্কার হয়ে যাবে তেমনি কোনও সংক্রমণ থাকলে তাও ধরা পড়ে যাবে।
পঞ্চাশ বছর বয়স পেরনোর পর প্রত্যেক পুরুষের উচিত পি এস এ বা প্রশ্নেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন টেস্ট করানো। এতে প্রস্টেটের সমস্যা থাকলে ধরা পড়ে যাবে।
চেস্ট এক্স-রে: ধূমপান, তামাক সেবনের অভ্যেস থাকলে ২৫ বছর অতি অবশ্যই চেষ্ট এক্স-রে করান।
ই সি জি: আজকাল অসংযমী জীবনযাত্রার কারণে কমবয়সিদের মধ্যেও হার্টের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই ২৫ বছর বয়সের পরে বছরে একবার বেসিক টেস্ট- ইসি জি করান।
ইকো কার্ডিওগ্রাফি: শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বেশিক্ষণ হাঁটলে হাঁফিয়ে পড়ছেন, তারা ইকোকার্ডিওগ্রাফি করিয়ে নেওয়া ভালো। এতে হার্টের ভালভের কোনও গন্ডগোল হলে তা আগে বোঝা যায়।
পি এফ টি: সিজিনাল শ্বাসকষ্টে, কাশি শ্বাসকষ্ট হলে পালমোনারি ফাংশন টেস্ট করা দরকার। এতে অ্যাজমা বা ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস থাকলে তা ধরা পড়ে যাবে।
ম্যামোগ্রাফি: পরিবারে ব্রেস্ট ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ৩৫ বছর বয়সের পর ম্যামোগ্রাফি করান।
প্যাপ স্মিয়ার: সারভাইকাল ক্যানসারের স্ক্রিনিং টেস্ট হল প্যাপ স্মিয়ার। উপসর্গ থাক আর নাই থাকুক, ২৫ বছর বয়সের পরে প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট অবশ্যই করান।
বিয়ের আগে আবশ্যিক রক্ত পরীক্ষা- ভাবী সন্তানের যাতে থ্যালাসেমিয়া না হয়, সেজন্য বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর রক্তপরীক্ষা করা ভীষণ জরুরি। হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষার সাহায্যে বোঝা যায় পাত্র বা পাত্রী থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা।
কোন টেস্ট চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া করাবেন না-
যে কোনও ধরনের এক্স-রে, এন আর আই, সিটি স্ক্যান, টি এম টি, ম্যামোগ্রাফি, এন্ডোস্কোপি বা কোলোনোস্কোপির মতো টেস্টগুলি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া করাবেন না। এতে শরীরে কুপ্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। তবে যাদের পরিবারে কোলন ক্যানসার থাকলে চল্লিশ বছরের পর বছরে একবার কোলোনোস্কোপি করাতে পারেন।