ডায়াবেটিস(Diabetes) ও থাইরয়েড(Thyroid) এর জন্য কি টেস্ট করাবেন ?

পরিসংখ্যান বলছে, ডায়াবেটিসে গোটা পৃথিবীতে সর্বাধিক মানুষ আক্রান্ত হন চীনে। আর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। আর এর জন্য দায়ী আজকের দিনের লাইফ স্টাইল। কথায় কথায় ফাস্ট ফুড আর ভাজাভুজি জাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণেই বেড়ে চলেছে সুগারে আক্রান্তের সংখ্যা। ঝুঁকি এড়াতে আগে থেকেই তাই জেনে নিতে হবে আপনার শরীরে ডায়াবেটিস রয়েছে কি না। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা জানার একমাত্র পথই হল মেডিক্যাল টেস্ট।

বয়স কত হলে সুগার টেস্ট করবেন:

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ৪৫ বছরের বেশি বয়স হয়ে গেলেই প্রতিবছর সুগার টেস্ট করানো উচিত নিয়ম করে। কিন্তু ভারতে যেহেতু ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি তাই ৩৫-এর ওপর বয়স হয়ে গেলেই সুগার টেস্ট করাতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মত অন্তত এমনটাই। দুই থেকে তিন বছর অন্তর একবার করে সুগার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। আর যদি বংশগতভাবে সুগারের প্রবণতা থাকে তাহলে অবশ্যই ২৫ বছর বয়সে সুগার টেষ্ট করিয়ে নেওয়া উচিত।

সুগার বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ কেমন:

• ব্লাড প্রেসার যদি হঠাৎ বেড়ে যায় তাহলে সুগার টেস্ট করিয়ে নেওয়া উচিত, • আজকের দিনে অনেকের আবার শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। এমন হলেও সুগার টেস্ট করিয়ে নেওয়া বাঞ্ছনীয়, • ওবেসিটি থাকলেও তা থেকে সুগারের সমস্যা দেখা দিতে পারে, মহিলাদের অনেক সময় পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যা হয়। এ থেকেও সুগার বাড়তে পারে,• প্রেগন্যান্সির সময় অনেক মহিলার ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। সেক্ষেত্রেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুগার টেস্ট করাতে হবে। অনেক সময় চার কেজির বেশি ওজনের শিশুর জন্ম দেন মা। সেক্ষেত্রে মায়ের সুগার টেস্ট করাতে হবে। কারণ মায়ের শরীরে যদি সুগার বেশ থাকে তাহলে মায়ের সেই গ্লুকোজ চলে যায় শিশুর শরীরে। আর তা থেকেই বেড়ে যায় শিশুর ওজন। ওজন কমে যাওয়াও সুগারের লক্ষণ হতে পারে। সুগার বেড়ে গেলে অনেক সময় ঘনঘন প্রস্রাব হতে থাকে। গলা শুকিয়ে গিয়ে বারবার জল তেষ্টা পেতে পারে। চোখের পাওয়ার মাঝেমাবোই পরিবর্তন হতে পারে। হাত- পা ঝিনঝিন করে অনেক সময়। কোনও জয়গায় কেটে যাওয়ার পর যদি সেই জায়গাটা না শুকোয় তাহলে সেটা সুগারের লক্ষণ হতে পারে। ফাঙ্গাল ইনফেকশন থেকেও অনেক সময় ডায়াবেটিসের সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে সুগার বেশি থাকলে অনেক সময় ঘাড়ের জায়গাটা কালো হয়ে যেতে পারে।

সুগারের মেডিকাল টেস্ট:

সুগার টেস্টের ক্ষেত্রে প্রথমত চিকিৎসক ফাস্টিং প্লাজমা গ্লুকোজ টেস্টের কথা বলতে পারেন। খাবার খাওয়ার আট ঘণ্টা পর এই টেস্ট করানো হয়। যদি সেই টেস্টে দেখা যায় ১২৬-এর ওপর গ্লুকোজ রয়েছে তাহলে বোঝা যাবে ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে। খালি পেটে যেমন সুগার টেস্ট করানো হয় তেমনই গ্লুকোজ খাইয়ে দেওয়ার এক ঘন্টা পরে একটি সুগার টেস্ট করিয়ে নেওয়া হয়। ৭৫ গ্রামের মতো গ্লুকোজ জল খাইয়ে দেওয়ার দু’ঘণ্টা পর সুগার টেস্ট করানো হয়। যদি দেখা যায় ২০০-র ওপর সুগার রয়েছে তাহলে ধরে নেওয়া হয় ডায়াবেটিস রয়েছে। আবার অনেকসময় র‍্যান্ডাম সুগার টেস্ট করানো হয়। যদি সুগারের কোনও লক্ষণ থাকে তাহলেই এই টেস্ট করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।

সুগারের আরও একটি টেস্ট হল এইচ বি এ ওয়ান সি টেস্ট। এটা হল তিন মাসের গড় সুগার টেস্ট। যেমন যদি দেখা যায় ফাস্টিং বেশি পাওয়া গিয়েছে তাহলে আরও একটা ফাস্টিং করিয়ে নেওয়া হল। এইভাবে সুগারের একটা গড় হিসেব নিয়ে চিকিৎসা করা হয়।

শিশুরাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে:

অনেক সময় এমন হতে পারে যে, একটি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। এরও একটা হিসেব রয়েছে। যদি দেখা যায় স্বাভাবিকের থেকে শিশুর ওজন ১২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে তাহলে সুগার টেস্ট করাতে হবে। আবার মায়ের যদি ডায়াবেটিসের প্রবণতা থাকে তাহলেও শিশুর সুগার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। এমনও দেখা গিয়েছে যে, দশ বছরের শিশুর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে সুগারের প্রবণতা। এমন ধরনের লক্ষণ যদি কোনওভাবে দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সুগার টেস্ট করিয়ে নেওয়া উচিত।

থাইরয়েডের টেস্ট কখন করাবেন:

থাইরয়েডের টেস্ট কোন বয়সে করাতে হবে তা নিয়ে একেক সংস্থার একেক মত। আমেরিকান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ৩৫ বছর বয়সের পর থেকেই প্রতি বছর একবার থাইরয়েড টেস্ট করানো উচিত। আবার ইংল্যান্ডের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে নির্দিষ্ট কোনও বয়স থেকেই থাইরয়েড টেস্ট করাতে হবে এমন কোনও কথা নেই। বরং থাইরয়েডের সিম্পটম দেখলে তবেই করাতে হবে থাইরয়েড টেস্ট।

সদ্যোজাত শিশুর থাইরয়েড টেস্ট অবশ্যই করানো উচিত:

থাইরয়েড প্রসঙ্গে একটা কথা সকলেরই জেনে রাখা ভালো যে, প্রতিটি শিশুর জন্মের পরেই থাইরয়েড টেস্ট করানো উচিত। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই সদ্যোজাত শিশুর এই টেস্ট করানো হয়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এই সচেতনতা এখনও সব মানুষের মধ্যে আসেনি। সদ্যোজাত শিশুর থাইরয়েড টেস্ট করানোর কারণ হল, থাইরয়েড গ্রন্থির ডেভেলপমেন্টের ওপর ব্রেন ডেভেলপমেন্টের বিষয়টি নির্ভর করে। একটি শিশুর তিন বছর পর্যন্ত ব্রেন-এর বিকাশ ঘটে। কিন্তু থাইরয়েড গ্রন্থিতে যদি কোনও সমস্যা থাকে ছোট থেকেই তাহলে ভবিষ্যতে শিশুর ব্রেনের বিকাশ ঘটে না, আর এর ফলে শিশু জড়ভরতের মতো হয়ে যায়। যেটা খুব বিপজ্জনক। যদি শিশুর থাইরয়েডের সমস্যা থাকে আর শিশুর জন্মের এক মাসের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করা হয় তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে আর কিছু করার থাকে না। এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সদ্যোজাত শিশুর এই টেস্ট করান অনেকে। কিন্তু সচেতনতাটা সব ক্ষেত্রে আসেনি।

হাইপো থাইরয়েডের লক্ষণ কেমন:

• স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েক কেজি বেশি ওজন বেড়ে যাওয়া।

• কোনও অটো ইমিউন ডিজিজ থাকলে (যেমন টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস)।

• কোলেস্টেরল খুব বেশি বেড়ে গেলে।

• কোনও মহিলার যদি বন্ধ্যাত্ব থাকে।

• মহিলাদের মেনস্ট্রুয়েশনের সময় অতিরিক্ত ব্লিডিং।

• শরীরে সবসময় একটা ক্লান্তিভাব।

• গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।

• শরীরে একটা শীত শীতভাব অনুভব করা।

• চামড়া খসখসে হয়ে যাওয়া।

• কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা।

• চুল পড়ার সমস্যা থাকলে।

• প্রেশার বেড়ে গেলে।

• পা সামান্য ফুলে গেলে।

হাইপার থাইরয়েডের লক্ষণ:

• খুব রোগা হয়ে গেলে।

• বুক ধড়ফড় করলে।

• হাত-পা কাঁপতে থাকে।

• বারেবারে পায়খানা করার প্রবণতা।

• চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসলে।

• ব্লাড প্রেশার যদি কোনওভাবে বেড়ে যায়।

মেডিকাল টেস্ট কেমন:

যদি হাইপো থাইরয়েডের সমস্যা থাকে তাহলে ফ্রি T4, TSH টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। যদি হাইপো থাইরয়েডের সমস্যা থাকে এবং নিয়মিত ওষুধ চলে তাহলে অবশ্যই সয়াবিন এড়িয়ে চলবেন।

হাইপার থাইরয়েড থাকলে T3, T4, ফ্রি T4, TSH টেস্ট করাতে হবে। তবে যে কোনও টেস্টই করাবেন চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে। আর থাইরয়েডের যদি সিম্পটম চোখে পড়ে তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।