সাধারণত হাড়ের কোনও ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে নিজের থেকে কোনও টেস্ট করা উচিত নয়। বরং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ চিকিৎসকরা রোগীর উপসর্গ দেখে তবেই রোগ পরীক্ষা করাতে দেন। তাই এই আলোচনায় হাড়ের অসুখ, উপসর্গ এবং টেস্টগুলি নিয়ে কথা বলা হল।
স্পন্ডাইলোসিস: অসুখটি হয় মেরুদণ্ডের সারভাইকাল অংশে। সারভাইকাল অংশটি আছে ঘাড়ে। মেরুদণ্ডের দুটি ভার্টিব্রার মাঝে থাকা ডিস্ক ক্ষয়ে যায়। ফলে দুটি ভাটিব্রা নিজেদের খুব কাছাকাছি চলে আসে। চাপপড়ে মেরুদন্ডে থাকা সুষুম্নাস্নায়ুতে। ফলে ঘাড়ে শুরু হয় মারাত্মক ব্যথা। যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে কাঁধে।
পরীক্ষানিরীক্ষা: স্পন্ডাইলোসিস হলে এক্স-রে তেও বিষয়টি দেখতে পাওয়া যাবে। এক্স-রে’তে কিছু ধরা না পড়লে চিকিৎসক এম আর আই, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করাতে দিতে পারেন। এক্স-রে থেকে রোগীর হাড়ের গঠনের কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না তা জানা যায়। এম আর আই করালে বোঝা যায় সারভাইকাল স্পাইন সংলগ্ন অংশের পেশি, ডিস্কের অবস্থা।
স্পন্ডিলাইটিস: নানা কারণে মেরুদন্ডের ভার্টিব্রার জয়েন্টে থাকা ডিস্ক সরে যায়। এতে দুটি ভাটিরা একে অপরের ওপরে চেপে বসে। ফলে মেরুদণ্ড সন্নিহিত স্নায়ুতে পড়ে প্রবল চাপ। হয় প্রচণ্ড ব্যথা। এই সমস্যা যে কোনও বয়সে হতে পারে। একেই বলে স্পন্ডিলাইটিস। এই রোগে মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে অনেকটা বাঁশের মতো দেখতে হয়। একই সঙ্গে ঘাড়ে, পিঠে, কোমরে, হিপ-এ ব্যথা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর যেকোনও ধরনের স্পন্ডিলাইটিসের প্রাথমিক মূল লক্ষণই হল ব্যথা।
পরীক্ষানিরীক্ষা: প্রাথমিকভাবে এক্স-রে করা যেতে পারে। চিকিৎসা শুরুর আগে নিশ্চিত হতে হয় স্পন্ডিলাইটিস কেন হয়েছে- রিউম্যাটয়েড, চোট লেগে না ইনফেকশনের কারণে সমস্যাটি হচ্ছে। ইনফ্লেমেটরি আথ্রাইটিস বা রিউম্যাটয়েড আর্থাইটিস হলে তার আবার নির্দিষ্ট টেস্ট আছে। আর ইনফেকশন হলে অনেক ধরনের পরীক্ষা আছে। যেমন, পেট স্ক্যান, এম আর আই স্ক্যান, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্রইড টেস্ট ইত্যাদি।
স্পন্ডাইলোলিস্থেসিস: স্পাইনে থাকা ভার্টিব্রাগুলির নিজস্ব স্বাভাবিক সজ্জা আছে। এই অসুখে সেই সজ্জার চ্যুতি ঘটে। মেরুদণ্ডে ওপরের ভার্টিব্রাটি নীচের ভাটিয়াটি থেকে অনেকটা এগিয়ে যায়। এক্ষেত্রে সুষুম্না কান্ডের মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত মেরুদন্ডের নীচের দিকে বা কোমরের অংশে হয়ে থাকে। তবে সারভাইকাল স্পাইন বা ঘাড়েও হতে পারে।ব্যথাই হল এর প্রাথমিক লক্ষণ।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা: সিটি স্ক্যান, এক্স-রে।
মেরুদণ্ডে সংক্রমণ: অ্যাকিউট ও ক্রনিক, শিরদাঁড়ার সংক্রমণকে মূলত এই দুটি ভাগেই ভাগ করা হয়ে থাকে। শিরদাঁড়ায় ব্যথা ও জ্বর হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। সংক্রমণ যত ছড়াতে থাকে ততই অন্যান্য সব লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। সংক্রমণ যখন ভার্টিব্রা হয়ে সেনসরি নার্ভে পৌঁছায় তখন রোগী জ্বলন বা বার্নিং সেনসেশন অনুভব করেন। শরীরের যে অংশের সেনসরি নার্ভ আক্রান্ত হয়, সেই অংশে রোগীর এমন অনুভূতি হয়। অর্থাৎ হাতের সেনসরি নার্ভ আক্রান্ত হলে রোগী হাতে জ্বালা ভাব অনুভব করবেন। সর্বোপরি, মোটর নার্ভের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। যে অঙ্গের মোটর নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই অঙ্গ আস্তে আস্তে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। একসময় রোগী একবারে পঙ্গু হয়ে যান। সেই কারণে কোনও রোগী পিঠে বা কোমরে ব্যথা, সঙ্গে কয়েকদিন ধরে হালকা জ্বর- এমন লক্ষণ নিয়ে দেখাতে এলে প্রাথমিকভাবে কিছু রক্ত পরীক্ষা করতে বলা হয়। প্রয়োজনে পিঠের এক্স-রে করারও পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
অষ্টিওপোরোসিস: মানুষের শরীরের অস্থিসজ্জার কাঠামো দুর্বল হয়ে যাওয়া হল অস্টিওপোরোসিস। অস্টিওপোরোসিস রোগে হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে সেটি ফোপরা যায়। সারা শরীরের হাড়েই এমন হতে থাকে। যার থেকে অস্থির কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়। আশঙ্কা থাকে সহজেই হাড় ভেঙে যাওয়ার।
লক্ষণ- রোগীর শরীরে যন্ত্রণা শুরু হয় শরীরের মোট হাড়ের ৬০ শতাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার পর। এরপর থেকেই হাড়ে ছোটখাট ফ্র্যাকচার দেখা দিতে থাকে। এই জন্যই অস্টিওপোরোসিসকে ‘সাইলেন্ট কিলার’ বলা হয়। ছোটখাট ফ্র্যাকচারগুলি বড় হওয়ার পর রোগীর দেহে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। এগুলি হল সারা শরীরে ব্যথা। শরীর ক্রমশ কুঁজো হয়ে যায়। অস্টিওপোরোসিস মেরুদণ্ডেও থাবা বসায়। শিরদাঁড়ার হাড় হয়ে পড়ে দুর্বল। হঠাৎ করে মাটিতে পড়ে গেলে, ধাক্কা লাগলে, হাঁচতে বা কাশতে গিয়ে, গাড়িতে ভ্রমণ করার সময় সামান্য ঝাঁকুনিতে, ভারী জিনিস তোলার সময় মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে স্পাইনাল কর্ড। রোগী শয্যাগত হয়ে পড়েন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
• অস্টিওপোরেসিস-এ হাড়ের টিউবের দেওয়াল পাতলা হয়ে যায় ও হাড়ের মধ্যেকার ক্যানাল বা নলের পরিধি বেড়ে হয়ে যায়। এই রোগে আক্রান্তের হাড়ের সাদা ভাব কমে যা সাধারণ এক্স-রে’তে দেখা যায়। বিভিন্ন বয়সে আমাদের শরীরের হাড়ের ঘনত্বের একটা নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে। অস্টিওপোরেসিসে আক্রান্ত হলে সারা শরীরের হাড়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফাটল ধরে। তাই রোগীকে ডুয়াল এনার্জি এক্স-রে অ্যাবসর্বশিওমেট্রি (ডেক্সা স্ক্যান) স্ক্যান করাতে বলা হয়। এতে রোগীর হাড়ের ঘনত্ব এবং ওই বয়সের সুস্থ মানুষের হাড়ের ঘনত্বের অনুপাত জানা যায়। আমেরিকার মতো দেশে, ৬৫ উর্ধ্ব প্রত্যেক মহিলার প্রতিবছর ডেক্সাস্ক্যান করা বাধ্যতামূলক। এর ফলে হাড় ভাঙার আগে বা বড় ক্ষতি হওয়ার পূর্বেই অস্টিওপোরোসিস রোগ শনাক্ত করা যায়।
• অস্টিওপোরেসিস জনিত অসুখের কারণে হাড় ভাঙার আগে, চিকিৎসক রোগীকে বি এম ডি টেস্ট বা বোন মিনারেল ডেনসিটি পরীক্ষা করাতে দিতে পারেন।
• রক্ত পরীক্ষায় (বোন টার্ন ওভার মার্কার) অস্টিওপোরোসিসজনিত হাড়ভাঙার ঝুঁকি নাপা হয়ে থাকে।
• সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় ক্যালসিয়ামের অভাব ধরা পড়ে।
স্পাইনাল স্টেনোসিস: স্টেনোসিস কথার অর্থ হল সংকোচন হওয়া বা সরু হয়ে যাওয়া। স্পাইনাল কর্ড মেরুদন্ডের যে হাড় দ্বারা তৈরি ক্যানেলের মধ্যে দিয়ে নামে, সেই ক্যানেলটা কোনও কারণে সংকীর্ণ বা সরু হয়ে যায়। ফলে মেরুদণ্ডের হাড়ের কাঠামো স্পাইনাল কর্ড সুষুম্না স্নায়ুর ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করে। একেই বলা হয় স্পাইনাল স্টেনোসিস।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। যেমন- ১) এম. আর, আই, ২) সিটি মাইলোগ্রাম।
সায়াটিকা: রোগীর সাধারণত কোমর ব্যথা হয় যা ক্রমশ পায়ের দিকে নামার মতো লক্ষণ থাকে। যাকে আমরা সায়াটিকা ব্যথা বলি। এই ব্যথা এক বা উভয় পায়ে হয়।
• হাত, পা ঝিন ঝিন করছে, পায়ে দুর্বলতা লাগছে। হাঁটার ধরন বদলে যাচ্ছে।
• রোগী বেশিক্ষণ হাঁটতে পারছেন না। একটু হাঁটলেই পায়ে, কোমরে ব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। এইসবই লক্ষণ হিসাবে থাকে। ক্লিনিকালি রোগ নির্ণয় করা বেশ শক্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। যেমন- ১) এম. আর. আই, ২) সিটি মাইলোগ্রাম।
ভিটামিন ডি এর ঘাটতি ভিটামিন ডি এর ঘাটতিতে হাড় দুর্বল এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। পিঠে কোমরে ব্যথা হয়। যাঁরা রোদ্রে কম বেরোন তাঁদের, মেনোপজের পর মহিলাদের এবং ৫০ বছর বয়সের পর প্রত্যেকের উচিত বছরে অন্তত একবার 25(OH)D পরীক্ষাটি করিয়ে নেওয়া।
প্রতি মিলিলিটার রক্তে ভিটামিন ডি এর মাত্রা হওয়া উচিত ২০ থেকে ৫০ ন্যানোগ্রাম। তাই প্রতি মিলিলিটার রক্তে ভিটামিন ডি এর মাত্রা ১২ ন্যানোগ্রামের নিচে চলে গেলে ভিটামিন ডি এর গাটতি হয়েছে বলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
অস্টিওআগ্রাইটিস: বয়সজনিত কারণে হাঁটুর জয়েন্টের কার্টিলেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ফলে হাড়গুলি পরস্পরের সঙ্গে গযা খেয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে। হাঁটুতে প্রবল ব্যথা শুরু হয়। ধীরে ধীরে রোগীর হাঁটাচলা করা বন্ধ হয়ে যায় যন্ত্রণার চোটে। প্রাথমিকভাবে রোগীকে এক্স-রে করাতে দেওয়া হয়। দরকার হলে চিকিৎসক এম আর আই করাতে দিতে পারেন হাঁটু সন্নিদিত পেশি ও কার্টিলেজের অবস্থা জানতে। এরপরেও প্রয়োজন হলে আর্থোস্কোপি (বিশেষ যন্ত্র, যার মধ্যে ক্যামেরা লাগানো থাকে। এর দ্বারা। হাঁটুর ভিতরের অবস্থা দেখা সম্ভব হয়।) করতে হতে পারে।
ইউরিক অ্যাসিড: মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলি রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা হওয়া দরকার ৬ মিলিগ্রাম। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলি রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক পরিমাণ ৭ মিলি গ্রাম। রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে সাধারণত পায়ের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা করে। বুড়ো আঙুলে সাঙ্ঘাতিক যন্ত্রণা হয়। স্থানটি লাল হয়ে ফুলে যায়। এছাড়াও গোড়ালিতেও ব্যথা হতে পারে। ডিনারে রেডমিট, অ্যালকোহল খেলে, সকালে ব্যথার কারণে মাটিতে পা ফেলা যায় না। হাঁটুর অস্থিসন্ধিতেও ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এইসব লক্ষণ দেখা গেলে অবশ্যই রক্তে ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করান।