কানে কত ধরণের অসুখ হতে পারে – জেনে নিন আজই

 অ্যাকিউট ওটাইটিস এক্সটারনা:

গরমকালে কিংবা বর্ষাকালে, যখন বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে তখন কানে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই সমস্যায় কানের বাইরের দিকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়। কান চুলকায়, প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং কানে হাত দিলেও ব্যথা করে। খাদ্য চেবানোর সময়েও ব্যথা করে, কানটা ভারী ভারী লাগে। কান বন্ধ হয়ে আছে মনে হয় এবং শুনতেও অসুবিধা হয়। কান থেকে মাঝে মাঝে পুঁজও বের হয়, কানের ভেতরটা লাল হয়ে যায়। চিকিৎসা করা হয় রোগের তীব্রতা অনুযায়ী। রোগীকে ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয়, সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ বা প্রয়োজন মতো স্টেরয়েড ড্রপ দেওয়া হয়। কানে ব্যথার জন্য গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে। আর কাঠিতে ভালো করে তুলো পেচিয়ে মলম লাগিয়ে কানের ভেতরে দিলে ব্যথা কম হয়। অসুখটি যে কোনও বয়সেই হতে পারে। তবে যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের অসুখটি ক্ষেত্রে বেশি হয়।

ক্রনিক ওটাইটিস এক্সটারনা:

কানের বাইরের দিকের অংশে দীর্ঘদিন ধরে কোনও সংক্রমণ থাকলে তাকে ক্রনিক ওটাইটিস এক্সটারনা বলে। এর অনেকগুলি কারণ থাকতে পারে-

কানের মধ্যে যদি বাইরের বস্তু ঢুকলে, টিউমার থাকলে,  দীর্ঘদিন ধরে কানে ময়লা জমলে।এইসব সমস্যার ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে, সংক্রমণ সারে না। আর অ্যাকিউট ওটাইটিস এক্সটারনার চিকিৎসা ঠিকমতো না হলে তা ক্রনিক ওটাইটিস এক্সটারনার রূপ নেয়। এক্ষেত্রে কান খুব চুলকায়। কান থেকে হালকা রস বা পুঁজ বেরয়। ব্যথা খুব একটা থাকে না। কানটা ভারী হয়ে থাকে, কানে কম শোনার সমস্যা হয়। কানের ভেতরটা ফুলে থাকে, ফলে কানের বাইরে থেকে পর্দা পর্যন্ত নলের মতো অংশটা সরু হয়ে যায়। সঙ্গে কানের ভেতর থেকে বেরনো পুঁজ বা রস শুকিয়ে গিয়ে কানকে বন্ধ করে রাখে। এই অসুখের ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে কানের ভেতরের ক্যানেল সরু হয়ে যায়। যাকে স্টেনোসিস অব দ্য ক্যানেল বলে। কানের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। গরম শুকনো সেঁক দেওয়া যেতে পারে। আর প্রাথমিকভাবে যে যে কারণে অসুখটি হয়, তার চিকিৎসা করা খুবই জরুরি।

কানে বাইরের বস্তু:

এই সমস্যা বাচ্চাদেরই বেশি হয়। তবে বড়রাও কান পরিষ্কার করতে যেসব জিনিস ব্যবহার করেন যেমন দেশলাই কাঠি, তুলো তা অনেক সময় কানের মধ্যে ঢুকে যায়। আর বাচ্চারা অনেক সময় ছোলা, মোটর বা পেনসিলের ছোট টুকরো, রাবারের টুকরো, কাগজের টুকরো কানের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে, এছাড়াও কানের মধ্যে ছোট ছোট পোকা হঠাৎ করে ঢুকে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোন ধরনের বস্তু কানের কতটা ভেতরে ঢুকেছে তা দেখে নেন চিকিৎসক। তারপর ফরসেপ দিয়ে সেই বস্তুটিকে বের করে দেওয়া হয়। অনেক সময় সিরিঞ্জি করে ছোলা, মটর বা গুলির মতো বস্তুগুলিকে বার করা হয়। অনেক সময় বস্তুগুলি কানের ভেতরে শক্তভাবে আটকে থাকে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে অজ্ঞান করে বস্তুটি বার করা হয়। কানের মধ্যে পোকা ঢুকলে পোকা ছটফট করে, খুব কষ্ট হয়। এইরকম হলে কানে একটু তেল দিলেই পোকাটা মরে যায়। তবে তেল গরম করার দরকার নেই একেবারেই। এরপর সিরিঞ্জিং করে মরা পোকা বের করে দেওয়া হয়।

এছাড়াও কানে আরেক ধরনের অসুখ হয়। সেটা হল কান দিয়ে রস বা পুঁজ বের হলে মাছিরা সে গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে কানের মধ্যে বাসা বাধে এবং কানের মধ্যে ডিম পাড়ে।সেই ডিম ফুটে লার্ভা তৈরি হয়, একে আমরা ম্যাগটস বলি। রোগটাকে বলা হয় মিয়াসিস (Miyasis)। এর চিকিৎসা দীর্ঘদিন ধরে করতে হয়। কানের মধ্যে ক্লোরোফর্ম বা ইথার দিয়ে পোকাগুলো মারা হয় এবং পরে ফরসেপ দিয়ে বা সিরিজিং করে পোকাগুলো বার করা হয়। কিন্তু ডিম থেকে যাওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করতে হয়। আর প্রয়োজন মতো ব্যথার ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। কন্ট্রোডার্মাটাইটিস নডিউলারিস হেলিশিস: এক্ষেত্রে কানের পাতার ধারে ছোট ছোট ফুসকুড়ি বা নডিউল তৈরি হয়। এগুলি খুব লাল হয়ে যায়, খুব ব্যথা করে। যেদিকের কানে এমন হয়, সেইদিকে কাত হয়ে শোয়াও যায় না। রোগটি কেন হয় তার সঠিক কোনও কারণ জানা যায়নি। তবে ওষুধ প্রয়োগে ব্যথা কমে। শল্য চিকিৎসা করে নডিউলগুলো বাদ দেওয়া হয়। তবে শল্য চিকিৎসার পর অসুখটি পুনরায় হতে পারে। বড়দেরই এই অসুখ বেশি হয়। আর মহিলাদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

পেরিকড্রাইটিস:

এটি একটি মারাত্মক অসুখ। এই অসুখে কানের পাতার বিকৃতি ঘটে। বিকৃতিটা পরবর্তীকালে ঠিক করা খুবই কঠিন হয়। কানের পাতাটা ভাঁজ হয়ে কুঁকড়ে যায়, একে কলিফ্লাওয়ার ইয়ার বলে। কানের পাতার কার্টিলেজের সংক্রমণের ফলে এই অসুখ হয়। কার্টিলেজটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। আবার পুড়ে গেলে, অ্যাকিউট ওটাইটিস এক্সটারনা হলে বা কোনও বিশেষ চোট থেকেও এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শল্য চিকিৎসা করে কার্টিলেজটা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সংক্রমণ সারাতে দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়। কানের পাতার বিকৃতি প্লাস্টিক সার্জারি করে কিছুটা ঠিক করা সম্ভব।

কিলয়েড অব দ্য অরিকল:

অনেক সময় দেখা যায়, মেয়েদের কান ফোটানোর পর জায়গাটা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় না। ফুলে থাকে, কাটা দাগ থাকে। আর যাদের কিলয়েড হওয়ার প্রবণতা থাকে তাদের ক্ষেত্রে জায়গাটা আরও ফুলে শক্ত হয়ে যায়। অনেক সময় কিলয়েডের মধ্যে ক্যানসারের প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর অনেক সময় কিলয়েড হয়। আর একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, শরীরের ওপরের অংশে কিলয়েড বেশি হয়। চিকিৎসাটা জটিল। কারণ শল্য চিকিৎসা করে কিলয়েড বাদ দিলেও পরবর্তীকালে অসুখটি হওয়ার আশঙ্কা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্টেরয়েড দিয়ে বা রেডিয়েশন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।

অরাল হেমাটোমা:

কানে হঠাৎ চোট লাগলে এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমাদের কানের কার্টিলেজের উপর একটা পাতলা আস্তরণ থাকে, যাকে পেরিকনড্রিয়াম বলে। আঘাত লাগলে পেরিকনড্রিয়াম এবং কার্টিলেজের মাঝের অংশে রক্ত বা রক্তের রস জমা হয়। একেই বলা হয় অরাল হেমাটোমা। এই অসুখের চিকিৎসাও জটিল। আমরা অনেক সময় জমে থাকা তরলটা বার করে দেওয়া হয়। তবে তা আবার জমা হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সে জন্য প্রেসার ব্যান্ডেজ দেওয়া হয় বা মোল্ড দেওয়া হয়, যাতে চাপ থাকলে তরল জমা হতে পারে না। এর ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসুখটি সেরে যায়। প্রয়োজনে শল্য চিকিৎসাও করা হয়।

গ্র্যানুউলোমা অব দ্য এক্সটারনাল অডিটারি ক্যানেল:

গ্র্যানুউলেশন টিস্যু হল টিউমারের মতো। সে থেকেই এসেছে গ্র্যানুউলোমা। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে এটা টিউমার নয়। শরীরের কোথাও আঘাত পেলে বা কেটে গেলে সেটা ধীরে ধীরে সারতে আরম্ভ করে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু অস্বাভাবিক টিস্যু তৈরি হয়। তাদেরই একটা রূপ হল গ্র্যানুউলোমা। আর গ্র্যানুউলোমাতে প্রচুর রক্ত নালি থাকে, তাই গ্র্যানুউলোমা দেখতে হয় টকটকে লাল। এর থেকে অনেক সময় রক্তপাতও হয়। কানের ক্যানেলের মধ্যেও গ্র্যানুউলোমা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তার সঙ্গে অনেক সময় ময়লা (খোল) বা ফরেনবডিও থাকে। এ জন্য একে ফরেন বডি গ্র্যানুউলোমাও বলে। এছাড়াও কানের মধ্যে আরও কিছু ধরনের সংক্রমণ থেকে গ্র্যানুউলোমা তৈরি হয়। এই সমস্যা সারতে অনেক সময় লাগে। অ্যান্টি বায়োটিক ড্রপ বা স্টেরয়েড ড্রপ ব্যবহার করলে অনেক সময় গ্র্যানুউলোমা সেরে যায়। কিন্তু ফরেন বডি বা কানে ময়লার কারণে যদি গ্র্যানুউলোমা হয়, সেক্ষেত্রে আগে সেগুলির চিকিৎসা করতে হয়। তবেই গ্র্যানুউলোমা সারে। এভাবে সমস্যা না মিটলে শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

অস্টিওমা:

অস্টিওমা হল কানের হাড়ের টিউমার। এই রোগ হলে কানে শোনার সমস্যা হয়। কানের মধ্যে ময়লা জমলে সেগুলোও বেরতে পারে না। ফলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কানের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। সবচাইতে বড় ব্যাপার হল, কানে কম শোনার সমস্যা হয়। শল্যচিকিৎসা করে অস্টিওমার চিকিৎসা করা হয়। এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় জানিয়ে রাখি, এক্সজস্টোসিস নামে আরও একটি সমস্যা কানে হয়। এটা দেখতে অনেকটা টিউমারের মতো হলেও আসলে টিউমার নয়। যারা পুকুরে স্নান করেন, তাঁদের কানে জল ঢুকে চুলকানির মতো হয়। এর ফলে কানের হাড়ের অতিরিক্ত বৃদ্ধি হয় টিউমারের মতোই। একেই বলে এক্সজস্টোসিস। চিকিৎসা সেই সার্জারি।

স্টেনোসিস অব দ্য এক্সটারনাল অডিটারি ক্যানেল:

এক্ষেত্রে কানের ভেতরের পথটা সরু হয়ে যায়। শরীরে যে কোনও সংক্রমণ হলে সময় মতো ক্ষতটির চিকিৎসা না করালে জায়গাটি ফুলে যায়, কানের ক্ষেত্রে, ক্ষত হওয়ার পর সময় মতো চিকিৎসা না করালে ভেতরের পথটি সরু হয়ে যায়। যাদের ক্রনিক ওটাইটিস এক্সটারনা থাকে তাদের ক্ষেত্রে এই অসুখের আশঙ্কা বেশি থাকে। ক্যানেলটা সরু হয়ে গেলে অনেক অসুবিধা হয়। তখন শল্য চিকিৎসা করে ক্যানেলটা বড় করে দেওয়া হয়।

পিনায় চোট বা আঘাত:

পিনা অর্থাৎ কানের পাতায় অল্প- স্বল্প চোট বা আঘাত লাগলে সাধারণ চিকিৎসায় সেরে যায়। কিন্তু কানের পাতার কার্টিলেজ কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পেরিকনড্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, একথা আগেই বলেছি।

বহিঃকর্ণে চোট বা আঘাত:

বহিঃকর্ণে চোট বা আঘাত নানাভাবে হতে পারে যেমন- খেলার সময় কানে বল লেগে, ধাক্কা লেগে বা কানে কেউ ঘুষি মারলে। এইসব ক্ষেত্রে শুধু বহিঃকর্ণের সঙ্গে কানের পর্দায় চোট লেগে পর্দা ফেটে যেতে পারে। আবার অনেক সময় সাউন্ড ট্রমা থেকে কানের পর্দা ফেটে অন্তঃকর্ণও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ইয়ার ফ্যাঙ্গাস:

জলবায়ুর তারতম্যের কারণে ইয়ার ফ্যাঙ্গাস খুবই হয়। বিশেষত, বর্ষাকালে আর গরমকালে। বর্ষাকালে পরিবেশ থাকে ভেজা ভেজা। আর গ্রীষ্মে ঘামে ভেজা প্যাঁচপ্যাচে অবস্থা হয়। কানে সাধারণত দু’ধরনের ছত্রাক হয়- ক্যানডিডা এবং অ্যাসপারজিলাস। এই দুটো ফ্যাঙ্গাস দু’রকম দেখতে হয়। ক্যানডিডা হয় সাদা ব্লটিং পেপারের মতো, আর অ্যাসপারজিলাস হয় কালচে রঙের। এই রোগের চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরে অ্যান্টি ফ্যাঙ্গাস ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। আর তার সঙ্গে জরুরি কানটাকে ঠিকভাবে পরিষ্কার রাখা। কানের ভেতরটা শুকনো রাখতে হবে। ফ্যাঙ্গাসের যে স্পোর তৈরি হয় তা কানের মধ্যে থেকে যাওয়ার ফলে চিকিৎসা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যেতে হয়।