ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউ টি আই বিষয়টি কী?
কিডনি, ইউরেটার, মূত্রথলি এবং মূত্রনালী এই চারটি অংশ নিয়ে গঠিত হয় মূত্রতন্ত্র বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট কথার অর্থ হল, যে রাস্তা দিয়ে ইউরিন শরীরের বাইরে হয়ে যায়। আমরা জানি, কিডনি ইউরিন তৈরি করে। এরপর ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন কিডনি থেকে ইউরেটারের মধ্যে দিয়ে ইউরিনারি ব্লাডারে ইউরিন জমা হয়। ইউরিন বেরিয়ে যায় ইউরো দিয়ে। এই সমগ্র পথের কোনও অংশ জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হলে তাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বলে। ই-কোলাই (এসেরকিয়া-কোলাই), স্টেফাইলোকক্কাস, সাপ্রোফাইটিকাস, ক্লেবসিয়েলা, প্রোটিয়াস, সিউডোমোনাস, এন্টেরোব্যাকটের নামে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক এই ধরনের সংক্রমণ জন্য দায়ী থাকে।
তবে দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ই-কোলাই (এসেরকিয়া-কোলাই) নামক জীবাণুটি ইউ টি আই রোগের জন্য দায়ী থাকে। এছাড়া অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ক্যাথেটার ব্যবহার থেকেও মূত্রতন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ ধরনের সংক্রমণে কারা বেশি আক্রান্ত হয়?
সাধারণত মহিলারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে পুরুষরাও আক্রান্ত হতে। পারেন • মহিলাদের এই অসুখ বেশি হওয়ার কারণ কী?
পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ইউরেথ্রা আকারে ছোট হয়। দৈর্ঘ্যে মাত্র ৪ সেন্টিমিটার হয়। এছাড়া ইউরেথ্রা এবং রেকটামের (মলদ্বার) কাছাকাছি অবস্থানের কারণেও ঘনঘন সংক্রমণের কবলে পড়তে হয় মহিলাদের। শৌচকর্মের পর পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন হওয়ার সময় রেকটাম থেকে মহিলাদের ইউরেথ্রায় ক্ষতিকর জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করার আশঙ্কা থাকে। তবে বেশ কতকগুলি অন্যান্য সমস্যা থাকলে, পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই সাবধানে থাকতে হবে।
কোন কোন সমস্যা?
ইউরিনারি ট্র্যাক্টে পাথর থাকলে ঠিকমতো ইউরিন পাস হয় না। ফলে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আবার বয়স্ক পুরুষ মানুষদের প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে গেলেও, তাদের ইউরিন পাসে সমস্যা হয়। তা থেকেও সংক্রমণ হয়। আবার কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ইউটেরাস নিচের দিকে নেমে আসে। এইরকম হলে, মূত্রথলি থেকে ইউরিন বেরনোর ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা যায়, যার থেকেও সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে থাকে।
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর কুঅভ্যেস থাকলেও সংক্রমণ হওয়ার ভয় থাকে। এছাড়া যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের ইউ টি আই হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অন্যদিকে বহু অফিস-কাছারিতে কর্মরত মহিলারা টয়লেটে যেতে পারেন না নানা কারণে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন টয়লেট ব্যবহারে তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। আবার কোনও কোনও অফিসে টয়লেটও থাকে না। ফলে তাঁদের দীর্ঘক্ষণ ইউরিন ধরে রাখতে হয়। প্রস্রাবের বেগ আসবে এই ভয়ে তাঁরা জলও কম খান। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আবার, যাঁরা ইমিউনো সাপ্রেসিভ ড্রাগ দীর্ঘদিন খান, তাদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এই অবস্থাতেও সংক্রমণ হওয়ার ভয় বেড়ে যায়।
বাচ্চাদের কি এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে?
স্কুলের টয়লেট নোংরা হলে বহু বাচ্চা টয়লেটে যেতে চায় না। প্রস্রাব চেপে রাখে, জল কম খায়। এসব কারণে বাচ্চাদেরও সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
এই অসুখের লক্ষণগুলি কী কী?
বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়-
প্রস্রাব করার সময় জ্বালা হয় ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব হয় তলপেটে ব্যথার অনুভূতি থাকে ইউরিন পাস করার পরেও মনে হয় কিছুটা থেকে গেল ইউরিনে দুর্গন্ধ • ইউরিন পাস করার পরে কিছুক্ষণ পর আবার ইউরিনের বেগ আসে বারবার টয়লেটে যেতে হয় সারাক্ষণ জ্বর জ্বর ভাব
কিছু কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে ইউরিনের সঙ্গে ব্লাড বেরতে পারে।বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করছে না। ওজন কমে যাচ্ছে। কারও কারও ঘনঘন পেটখারাপ হয়। গায়ে অল্প অল্প জ্বর লেগে থাকে। কখনও জ্বরের তীব্রতা বেড়ে যায়। • ঠিকসময়ে ইউ টি আই-এর চিকিৎসা না হলে এবং বারবার সংক্রমণ হতে থাকলে শরীরে কোন ধরনের জটিলতা হতে পারে?
ঠিকসময়ে চিকিৎসা না হলে জীবাণুগুলো মূত্রথলি থেকে কিডনিতে চলে যায়। সেখান থেকে কিডনি ফেলিওর হওয়া আশ্চর্য কিছু নয়। এছাড়া জীবাণু রক্তে ছড়িয়ে গিয়ে সেপটিসেমিয়া হওয়ার ভয় থেকেই যায়। এই অবস্থায় রোগীর প্রাণ নিয়ে টানটানি পড়ে যায়। আরও একটা বিষয় জানা দরকার, তা হল মহিলাদের গর্ভাবস্থায় এই সংক্রমণ হলে খুব সাবধানে থাকতে হবে। এইসময় সঠিক চিকিৎসা না হলে মা এবং গর্ভস্থ সন্তানের চরম ক্ষতি হতে পারে।
কী কী রোগপরীক্ষা করাতে হয়? এগুলো প্রাথমিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষাগুলি করে বোঝা যায় কোন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা রোগী আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও রোগীকে আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে দেওয়া হয় প্রয়োজন বুঝে।
চিকিৎসা কী?
আগেই বলেছি ই-কোলাই নামে একটি ব্যাকটেরিয়াই এই রোগের উৎস। একবার সংক্রমণ হলে এই ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব একজনের মধ্যে বারবার ফিরে আসে। তাই সময়মতো যদি অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া হয়, তাহলে এর থেকে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসকরা রিপোর্ট অনুযায়ী উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক এবং ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন। ইনফেকশন হয়ে গেলে রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং প্রচুর পরিমাণে জল পান করতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে জল পান করলে ইউরিন বেশি হয় এবং ব্যাকটেরিয়াগুলি বের হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে প্রতিদিন অন্তত ৩ লিটার জল পান করতেই হবে।
আর একটা বিষয় মনে রাখবেন, অ্যান্টিবায়োটিক দু’দিন খেলেই উপসর্গ কমে যায়। তা বলে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিলে চলবে না। পুরো কোর্স শেষ করতে হবে। না হলে পরবর্তীকালে পুনরায় সংক্রমণ হলে ওই অ্যান্টিবায়োটিক আর রোগীর দেহে কাজ করবে না।
রোগ প্রতিরোধের কোনও উপায় আছে কী?
স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবননির্বাহই পারে ইউ টি আই থেকে মুক্তি দিতে। গ্রামের দিকে মহিলাদের নোংরা পুকুরে স্নান করা বন্ধ করা উচিত। এছাড়া মেনস্ট্রুয়েশনের সময় স্বাস্থ্যবিধির দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার। কোনও অপরিষ্কার কাপড়-জামা বারংবার ব্যবহার করা উচিত নয়। এছাড়া ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও উপযুক্ত নিরাপত্তা নিয়ে তারপর কাছাকাছি আসুন। মনে রাখবেন সতর্কতাই পারে যে কোনও ধরনের অবাঞ্ছিত অসুখবিসুখকে দূরে রাখতে।
এই প্রসঙ্গে জানাই, আধুনিক কিছু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে নিয়মিত ক্র্যানবেরি জুস এক্সট্রাক্ট এবং পর্যাপ্ত জল পান করলে ইউ টি আই থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।