গ্যাসের সমস্যা কার না হয় – কেন হয় ? কি করা যায় ?

গ্যাস কী?

গ্যাস তৈরি হয় আমাদের অন্ত্রে (ইনটেসটিন)। প্রথমেই জানিয়ে রাখি, এই গ্যাস আর বায়ুমণ্ডলের গ্যাসের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। খালি পেটে মানুষের গ্যাস্ট্রোইনটেসটিনাল ট্র্যাক্টে প্রায় ২০০ মিলিলিটার গ্যাস থাকে।

গ্যাসের উৎপত্তি অনেক কারণে হতে পারে, যেমন বাতাস গিলে ফেলা, রক্ত থেকে পাকস্থলী বা অন্ত্রের মধ্যে গ্যাস চলে আসা। বৃহদন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার কাজকর্মেও গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস মূলত ঢেকুর এবং বা পায়ুদ্ধার দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর কিছু জীবাণু অন্ত্রের গ্যাসকে নিজেদের পরিপাকে ব্যবহার করে। এই হল আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে গ্যাসের কথা।

গ্যাসের অনুভূতি

একেক জন মানুষের একেক রকম। কেউ কেউ বলেন গ্যাসের ফলে পেট ফুলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলেন গ্যাস হয়েছে বলে ঢেকুর উঠছে, কারও পায়ুদ্বার দিয়ে গ্যাসের নিঃসরণ হয়। কেউ বলেন গ্যাসের কারণে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেকের আবার পেটে ব্যথা, পিঠে ব্যথা বা বুকে ব্যথার মতো লক্ষণও থাকে।

চিকিৎসা-

রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। রোগীকে পরীক্ষা করে অনেক সময় দেখা যায় ক্ষুদ্রান্ত্রে গ্যাসের পরিমাণ খুব বেশি নেই, তবু খুব তীব্রভাবে গ্যাসের অনুভূতি রয়েছে। আসলে খাদ্য তার স্বাভাবিক গতিতে খাদ্যনালি, পাকস্থলী হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে না নামলে বা খাদ্য নামার স্বাভাবিক গতি ব্যহত হলে তখনই গ্যাসের অনুভূতি হয়। তবে এর মধ্যে একটা মানসিক ব্যাপারও জড়িত। আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রে অসংখ্য স্নায়ু থাকে। এই নার্ভগুলির মাধ্যমে গ্যাস হওয়ার অনুভূতি মস্তিষ্কে যায়। ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত নার্ভের মধ্য দিয়ে অনুভূতি যাওয়ার পথে কিছু কিছু নার্ভের সংযোগস্থলে বিশেষ রাসায়নিকের ক্ষরণ হয়। যে রাসায়নিকগুলি গ্যাসের এই বিবর্ধিত অনুভূতিটা তৈরি করে।

এখন জোরকদমে গবেষণা চলছে যাতে ওই বিশেষ রাসায়নিকগুলিকে নিষ্ক্রিয় করা যায়, যাতে গ্যাসের অনুভূতিটা কম হয়। গ্যাসের মূল সমস্যা হল দুটি।

১) ক্ষুদ্রান্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দ কমে যাওয়া।

২) ক্রমাগত মস্তিষ্কে এই অনুভূতি হয় যে পেটে গ্যাস জমেছে।

গ্যাস হওয়ার বিশেষ কিছু লক্ষণ:

পেটের নানা স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ব্যথা। কখনও ডানদিকে, কখনও বাঁ দিকে, পেটের  ওপরে বা নিচের দিকে।

খাদ্যগ্রহণের পরেই পেটের ওপর অংশে, বাদিকে যদি ভারী ভাব বা ফোলা ভাব হয়, তাহলে সেটা গ্যাসের কারণে হতে পারে। সাধারণত গ্যাসের অনুভূতিটা কষ্টদায়ক কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারাত্মক ক্ষতিকারক নয়।

খাদ্য এবং গ্যাস-

এক্ষেত্রে বলি, সবার যে একইধরনের খাবার থেকে গ্যাস হবে এমন নয়। অর্থাৎ কারো বেগুন খেয়ে গ্যাস হচ্ছ বলে অন্য কারো তাই হবে তা নয়। কারো কুমড়ো খেয়েও গ্যাস হয়।

তবে কতকগুলি খাবার আছে সেসব খাবারে সত্যি সত্যিই গ্যাস হয়।

১) যেমন, শতকরা ৯০ জন মানুষেরই দুধ খেলে সমস্যা হয়। হয়তো অধিকাংশরই ছোটবেলায় কোনও সমস্যা ছিল না, বড় হবার পর দুধ থেকে গ্যাসের সমস্যা শুরু হল। দুধ খেলে পেট ফুলে যাওয়া, পায়ুদ্ধার দিয়ে গ্যাস নিঃসরণ হওয়া, মুখে টকটক ভাব, এগুলো হয়।

কারণ ক্ষুদ্রান্ত্রে ল্যাকটোজ নামে এনজাইম থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই এই এনজাইমের ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে সমস্যার শুরু হয়। তবে দই বা ছানা খেলে এই সমস্যা হয় না।

২) লেবু অর্থাৎ সাইট্রাস জাতীয় ফল খেলে অনেকেরই পেট ফুলে গ্যাসের সমস্যা হয়, পেটের গোলমাল দেখা দেয়।

৩) পিয়াজ থেকেও গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।

৪) অতিরিক্ত মশলাদার খাবার থেকেও গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।

এছাড়া অনেকের দুধ, গম, জাতীয় খাবার, পিয়াজ, রসুন, আম, আপেল ইত্যাদি খেলে গ্যাসের সমস্যা হয়। এছাড়াও রয়েছে মাশরুম, যা অনেকেরই প্রিয়। কিন্তু এতে পেটে গ্যাসের সমস্যা হয়। এবারে বলি, গম জাতীয় খাবার থেকে অসুবিধার কথা। এই অসুবিধা মূলত হয় উত্তর ভারতে। তবে আমাদের এখানেও মাঝে মধ্যে দেখা যায়। একে বলে সিলিয়াক ডিজিজ। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রান্ত্রের মিউকোসাগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে গম জাতীয় খাবার খেলেই বদহজম হয় এবং ডায়রিয়া দেখা দেয়। এছাড়া বিনস, মটরশুঁটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি থেকেও অনেকের গ্যাসের সমস্যা হয়।

সমস্যা থেকে মুক্তির উপায়:

প্রথমেই দরকার সমস্যার সঠিক কারণটাকে খুঁজে বার করা। অনেকসময় দেখা যায় গ্যাসের সমস্যার মূল কারণ কোষ্ঠবদ্ধতা, তখন দরকার কোষ্ঠবদ্ধতার চিকিৎসা করা। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় পেট ফুলে যাচ্ছে কিন্তু সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে ইনটেসটাইনের মোবিলিটি (চলাচল) বাড়াবার জন্য ওষুধ দিতে হয়।

এছাড়া গ্যাস হয়েছে, মস্তিষ্কে এই অনুভূতি কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়। আবার নিয়মিত প্রাণায়াম এবং শরীরচর্চাও খুব উপকারে আসে। আর খাবারের ক্ষেত্রে একটু বুঝে খেলে সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

গ্যাস থেকে বিপদ-

গ্যাসের সমস্যার ক্ষেত্রে দেখা যায় ৮০- ৯০ শতাংশ মানুষের খুব জটিল কোনও পেটের অসুখ নেই। তবে বাকিদের ক্ষেত্রে জটিলতা থাকতে পারে সেক্ষেত্রে বিশেষ কিছু লক্ষণ থাকে যেমন-

•  ওজন কমে যাওয়া।

•  মাঝে মাঝে জ্বর হওয়া।

• রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়া।

•  মলের সঙ্গে রক্ত পড়া (অকাল্ট ব্লাড)।

• রক্তে ই.এস.আর-এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া।

গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে উপরোক্ত লক্ষণ থাকলে বিশেষভাবে তাদের পরীক্ষা করে। সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে হবে। পেটে কোনও জটিল অসুখ, যেমন প্যাংক্রিয়াটাইটিস, গলস্টোন, অস্ত্রে ঘা, ক্যানসার ইত্যাদি আছে কি না জানতে হবে।

সবশেষে – পেটে দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস হলে আমাদের ভাবতে হবে হজমের সমস্যা বা বদহজম হচ্ছে কি না। তার কারণ চর্বি জাতীয় খাবার ঠিকমতো হজম না হলে দুর্গন্ধ যুক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়।

এক্ষেত্রে আমাদের দেখতে হবে ইনটেসটাইনের ভিতরের দেওয়ালে কোনও অসুখ আছে কি না বা প্যাংক্রিয়াস ঠিকমতো কাজ করছে কি না বা অস্ত্রে কোনওরকম ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ হয়েছে কিনা, এসব জেনে সঠিক চিকিৎসা করলেই রোগ নিরাময় হবে।