টাইপ-১ ডায়াবেটিস কি?

টাইপ-১ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মধ্যে পার্থক্য কী?

সাধারণ মানুষের পক্ষে এই দুই ডায়াবেটিসের মধ্যে পার্থক্য করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা করার মধ্যে দিয়ে ফারাকটা বোঝা সম্ভব। যেমন- টাইপ-১ সাধারণত ১০-১৫ বছর বয়সি বাচ্চাদের হয়। তাই তো এই ডায়াবেটিসকে এক সময় জুভেনাইল ডায়াবেটিসও বলা হত। অন্যদিকে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাধারণত ৩০ বছরের পরেই শরীরে বাসা বাঁধে।

টাইপ-১ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি হঠাৎ করে শুরু হয় এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করে। টাইপ ২-এর ক্ষেত্রে একেবারে উলটো ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে রোগী বুঝতেই পারেন না তার শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছে। কারণ এই রোগ খুব ধীরে ধীরে ছড়ায়। ফলে তেমন কোনও লক্ষণের বহিঃপ্রকাশই ঘটে না ডায়াবেটিস ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি দেখা যায় শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ ঠিক ভাবে কাজ করতে পারছে না, তাহলে বুঝতে হবে রোগী টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রসঙ্গত, টাইপ-১ যেহেতু হঠাৎ করে হয় তাই এই রোগের কারণে সাধারণত শরীরের অন্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

টাইপ-১ ডায়াবেটিসে কারা বেশি আক্রান্ত হয়?

ছোট বাচ্চারাই সাধারণত এই রোগের শিকার। তবে আশার বিষয় আমাদের দেশে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রকোপ খুব কম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এদেশে ১০০ জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে মাত্র ২-৩ জন টাইপ-১ এ আক্রান্ত। প্রসঙ্গত, যে সব বাচ্চার বিসিজি, পোলিও, রুবেলা, ট্রিপল অ্যান্টিজেন ও মিজল ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে না তাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। •

কী কী কারণ দায়ী?

অনেকগুলি কারণে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে তার মধ্যে অন্যতম হল জেনেটিক কারণ। যাদের পরিবারে এই রোগ হওয়ার ইতিহাস আছে, সেই সব বাচ্চার টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অন্যান্য বাচ্চার থেকে বেশি থাকে। দ্বিতীয়ত, অটোইমিউনিটি বা ইমিউনোলজিকাল কারণ এই রোগের প্রসারে অনেকাংশেই দায়ী। এক্ষেত্রে নিজেরই তৈরি করা প্রোটিনকে চিনতে না পেরে শরীর তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এর ফলে ওই অ্যান্টিবডি শরীরের বিভিন্ন কোষকে নষ্ট করতে শুরু করে। এই কারণে অগ্নাশয়ের মধ্যে থাকা বিটাসেল, যা ইনসুলিন তৈরি করে, তা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে টাইপ- ১ ডায়াবেটিস হবে। এছাড়াও আরও একটি কারণে বাচ্চারা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যাদের পারিবারিক এই রোগের ইতিহাস আছে এবং সেই সঙ্গে ছোটবেলায় সব ধরনের ভ্যাকসিন নেওয়া নেই, তাদের টাইপ-১ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। যেমন- ককসাকি, বিভিন্ন রকমের এন্টারো ভাইরাস, রুবেলা এবং মিজল ভাইরাসের কারণে সংক্রমণ হলে বাচ্চার টাইপ-১ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তবে যেসব বাচ্চা মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়, তারা টাইপ-১ ডায়াবেটিসে কম আক্রান্ত হয়।

কী ধরনের লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে?

সাধারণত যেসব লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় সেগুলি হল – বাচ্চার ঘনঘন প্রস্রাব পাবে জলতেষ্ট এবং খিদে বেড়ে যাবে অস্বাভাবিক হারে ওজন কমতে শুরু করবে বমি হবে রোগীর শরীরে সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম দ্রুত কমতে শুরু করবে প্রায়ই ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন হবে ঘন ঘন জ্বর হবে • ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিছুক্ষেত্রে খিঁচুনি হওয়ার মতো লক্ষণও দেখা যেতে পারে।

রোগী টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে কিনা জানতে কী কী টেস্ট করা হয়?

সাধারণত তিনটি টেস্ট করা হয়ে থাকে। খালি পেটে এবং গ্লুকোজ খেয়ে ব্লাড সুগার টেস্ট এবং প্রস্রাবে সুগার ও অ্যাসিটোন আছে কিনা জানতে ইউরিন টেস্ট করা হয়। খালি পেটে রক্তে সুগারের মাত্রা ১২৫ এবং ভরা পেটে যদি ১৯৯ এর উপরে থাকে তাহলে বুঝতে হবে ওই বাচ্চা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রস্রাবেও যদি সুগার এবং অ্যাসিটোন পাওয়া যায় তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা উচিত। কারণ টাইপ-১ ডায়াবেটিসে রোগীর শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়। প্রসঙ্গত, খরচসাপেক্ষ কিছু অ্যান্টিবডি টেস্ট থেকেও শরীরে ডায়াবেটিসের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে এই সব পরীক্ষাগুলি না করালেও চলে।

চিকিৎসা?

টাইপ-১ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, জীবনযাত্রার পরিবর্তন। এক্ষেত্রে প্রতিদিন নিয়ম করে শরীরচর্চা তো করতেই হবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সুষম খাবার খেতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওষুধ হিসাবে একমাত্র ইনসুলিন নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাধারণত কম ডোজে ইনসুলিন শুরু করে দুই-তিন দিন বাদ থেকে ডোজ বাড়ানো হয়ে থাকে। আরেকটি বিষয় বাবা-মায়েদের মাথায় রাখতে হবে, তা হল বাচ্চাকে ইনসুলিন নেওয়া শেখাবেন। এতে ইনসুলিন নেওয়ার ভীতি যেমন কমবে, তেমনি গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার কারণে ওষুধও ভালো কাজ করবে। আর যারা একান্তই নিজে নিতে পারবে না তাদের ক্ষেত্রে মায়েদের ইনসুলিন কীভাবে দিতে হয়, তা শিখে নিতে হবে। সেই সঙ্গে আরও কতগুলি বিষয় বাবা-মায়েদের মনে রাখা আবশ্যিক। যেমন- জ্বর বা ইনফেকশন হলে হঠাৎ করেই ইনসুলিন দেওয়া বন্ধ করে দেবেন না। বরং সেই সময় বেশি ডোজে ইনসুলিন দিতে হতে পারে। খেলতে যাওয়ার আগে বাচ্চা যাতে কিছু খেয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। না হলে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বাচ্চা খেলতে খেলতে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। আপনার বাচ্চা যে স্কুলে পড়ে সেখানকার শিক্ষকদের তার অসুস্থতার বিষয়ে অবশ্যই জানিয়ে রাখবেন • নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাচ্চার সুগার পরীক্ষা করবেন। দেখবেন সুগারের মাত্রা কমছে কি না। যদি না কমে তাহলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজন মতো ইনসুলিনের ডোজ বাড়াবেন। সেই সঙ্গে তিন মাস অন্তর বাচ্চার এইচ বি এ ১ সি (HBAIC) পরীক্ষা করাতে ভুলবেন না। এই পরীক্ষাটি করা হয় তিন মাসের সুগারের গড় হিসাবে জানতে। এই টেস্টের রেজাল্ট যদি ৭ বা তার কম হয় তাহলে চিন্তার কিছু নেই। আর যদি বেশি হয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবেন। চিকিৎসা শুরু করতে অকারণ দেরি করবেন না। আর যদি আপনার বাচ্চা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যায় তাহলে তক্ষুনি তাকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করবেন।

এই রোগ থেকে কী ধরনের জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে?

ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে ৫ বছরের মধ্যে রোগীর কিডনি, চোখ এবং লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই সঙ্গে রোগীর নার্ভের জটিল সমস্যাও হতে পারে। এমনকী অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে পাঁচ বছরের অনেক আগেই ডায়াবেটিক কিটোসিসে আক্রান্ত হয়ে রোগীর প্রাণহানি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।

রোগীরা কী কী সাবধানতা নেবেন?

এই রোগে যেহেতু বাচ্চারই বেশি আক্রান্ত হয় তাই বাবা-মাকে সব সময় তাদের বাচ্চার পাশে থাকতে হবে। তাদের মনোবল বাড়াতে হবে। ইনসুলিনের ভয় কমাতে বাচ্চাকে বোঝাতে হবে যে এই ইনজেকশনটি তাদের বন্ধু। আর অবশ্যই একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, টাইপ-১ এ আক্রান্ত বাচ্চা খেলাধুলা করতে পারে, ক্ষতি নেই। তবে তা যেন অনিয়ন্ত্রিত না নয়। এতে বাচ্চার শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। আরেকটি বিষয় হল, যখনই মনে হবে বাচ্চার সুগার নেমে যাচ্ছে, তখনই সুগার মাপবেন। যদি দেখেন সুগার ৭০-এর নিচে নেমে গেছে তাহলে তখনই চিনি বা কিছু খাবার খাইয়ে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক করতে হবে। বাচ্চা সামান্য সুস্থ হলে তাকে ভাত রুটির মতো খাবার দেবেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।

এই রোগে ডায়েটের ভূমিকা কতটা?

টাইপ-১ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা যে চারটে থামের উপরে দাঁড়িয়ে তার অন্যতম হল ডায়েট। বাকি তিনটি হল- শরীরচর্চা, রোগ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং ঠিক মতো ইনসুলিন নিয়ে যাওয়া। তাই সুস্থ থাকতে শুধু ইনসুলিন নিলেই চলবে না। দেহের ওজন অনুযায়ী চিকিৎসক যেমন ডায়টে চার্ট বানিয়ে দেবেন, সেই মতো খাবার খেতে হবে। চারটে রসগোল্লা খেয়ে একটু বেশি করে ইনসুলিন নিলেই চলবে, এমন অভ্যাস কিন্তু খুবই ক্ষতিকর।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া কি সম্ভব?

অবশ্যই সম্ভব। তবে তা খুবই খরচ সাপেক্ষ চিকিৎসা। রোগীর যদি আইলেট সেল ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় তাহলেই একমাত্র এই রোগ থেকে মুক্তি মেলে। তবে এই ট্রান্সপ্লান্ট তখনই সফল হয়, যখন রোগীর লিভার গ্রাহকের থেকে নেওয়া ওই কোষ গ্রহণ করে। প্রসঙ্গত, রোগীর শরীরে যেহেতু অন্যের সেল ঢোকান হয়, তাই রোগীকে সারা জীবন ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুষ খেয়ে যেতে হয়। সব মিলিয়ে এটি খুবই জটিল একটি পদ্ধতি। খরচও অনেক। তাই এই ধরনের চিকিৎসা করার থেকে ইনসুলিন নেওয়াই বরং অনেক সহজ। আর যদি একান্তই ইনজেকশন নিতে ভয় করে তাহলে বিকল্প হিসাবে ইনসুলিন পাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে।