টাইপ ২ ডায়াবেটিস কি ? লক্ষ্মণ, নির্ধারণ ও চিকিৎসা

ডায়াবেটিস দু’ধরনের হয়। একটাকে বলে টাইপ-১ এবং অন্যটাকে বলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ সাধারণত ৫-১৫ বছরের বাচ্চাদের হয়। তবে ৫ বছরের কমবয়সিদের এবং ১৫ বছরের পরেও হতে পারে। এই ডায়াবেটিসের কারণ টাইপ- ২ ডায়াবেটিসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আগে টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে বলা হত ম্যাচিউরিটি অনসেট ডায়াবেটিস। এখন টাইপ-২ ডায়াবেটিস কথাটা ব্যবহার হয়।

এই ডায়াবেটিস মূলত আমাদের জীবনশৈলীর ওপর নির্ভর করে, আগে আমরা জানতাম টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৪০ থেকে ৫০ বছরে শুরু হয়। যাঁদের একটু ওজন বেশি এবং অলস জীবনযাপন করতে তাদের মধ্যে বেশি দেখা দিত। এখন দেখা যাচ্ছে অনেক কম বয়সে, ৩০ বছরের আশপাশে অসুখটি বেশি সংখ্যায় দেখা দিচ্ছে, এমনকী স্কুল পড়ুয়াদের মঞ্চেও টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা দিচ্ছে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস কী?

যাঁরা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের শরীরে ইনসুলিন কম তৈরি হয় এবং ইনসুলিন রেজিস্টেন্স দেখা দেয়। অর্থাৎ শরীরে তৈরি হওয়া ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।

তাছাড়াও অন্যান্য কারণও আছে, যেমন আমাদের লিভার থেকে বেশি পরিমাণ গ্লুকোজ বেরয় এবং আমাদের কিডনি অনেকটা গ্লুকোজ জমিয়ে (Conserve) রাখে, এছাড়াও অন্যান্য আরও কারণ আছে। কিন্তু মোটামুটিভাবে কম ইনসুলিন বেরনো এবং ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়াতে যে ডায়াবেটিস হয় তাকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বলা হয়। এই অসুখটি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য অনেকগুলি কারণ দায়ী যেমন

১) অতিরিক্ত ওজন

২) অলস জীবনযাপন, শরীর চর্চা বা কায়িক শ্রমে অনীহা

৩) জেনেটিক ফ্যাক্টর অর্থাৎ পরিবারে এই রোগ হওয়ার ইতিহাস থাকলে সেই পরিবারের সুস্থ মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এর একটা হিসাবও আছে। যদি বাবা এবং মা উভয়েই ডায়াবেটিক হন তাহলে সন্তানদের মধ্যে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ আশঙ্কা থাকে ডায়াবেটিক হবার।

আবার বাবা বা মায়ের যে কোনও একজনের ডায়াবেটিস থাকে তাহলে সন্তানদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে।

তবে পরিবারে ডায়াবেটিস হওয়ার ইতিহাস আছে এমন পরিবারের ছেলেমেয়েরা ছোট থেকে নিয়মিত শরীর চর্চা এবং পরিমিত আহারে অভ্যস্ত হয় তাহলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

আবার বিপরীতও হতে পারে, যদি ছোট থেকে খুব মোটা এবং অলস হয় তাহলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, এবং রোগের জটিলতাও বাড়ে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণ দু’রকম। প্রথম হল জিনগত। আর দ্বিতীয় কারণ আমাদের খারাপ জীবনযাত্রার প্রণালী। এছাড়াও অসুখটিকে বাড়িয়ে তুলতে কতকগুলি কুঅভ্যাসও দায়ী, যেমন-

১) ধূমপান

২) অতিরিক্ত মদ্যপান

৩) অপরিমিত আহার

৪) অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া

এসবের ফলে সুগার নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয় এবং শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও ক্ষতি হয়।

১) মাইক্রোভাসকুলার জটিলতা যেমন চোখ, কিডনি ও নার্ভের অসুবিধা

২) ম্যাক্রোভাসকুলার জটিলতা যেমন হার্ট অ্যাটাক, মস্তিস্কের স্ট্রোক এবং পেরিফেরিয়াল ভাসকুলার ডিজিজ। রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাটা সবথেকে জরুরি, তার সঙ্গে অন্যান্য রিক্স ফ্যাক্টর যেমন রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা, ওজন নিয়ন্ত্রণ করাটাও জরুরি সঙ্গে ডায়াবেটিক এডুকেশন থাকলে ভালো হয়।

রোগ লক্ষণ

টাইপ-২ ডায়াবেটিসে অনেকেরই অনেকসময় রোগ লক্ষণ বা বহিঃপ্রকাশ থাকে না। মানে লক্ষণবিহীন রোগও হতে পারে। অনেকসময় যেটা হয় কেটে গিয়ে ঘা শুকাচ্ছে না তখন ধরা পড়ল সুগার বেশি বা বাড়িতে সুগার মাপার মেশিন আছে শখে পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ল এরকম হঠাৎ করেই ধরা পড়তে পারে। তবে রক্তে সুগারের মাত্রা বেশি থাকলে সাধারণভাবে যে লক্ষণগুলি দেখা যায় তা হল-

১) খুব বেশি জলতেষ্টা পাওয়া

২) বারবার প্রস্রাব হওয়া

৩) খুব দুর্বল লাগা

৪) ধীরে ওজন কমে যাওয়া

৫) কোনও স্থানে সংক্রমণ হলে চট করে না সারা

৬) কাঁটা ছেঁড়া শুকতে অনেক সময় লাগা।

৭) বারংবার খিদে খিদে ভাব ইত্যাদি।

চিকিৎসা:

চিকিৎসার দিকটা দুটো ভাগে ভাগ করা হয়।

১) নন ফার্মাসিউটিক্যাল অর্থাৎ ওষুধবিহীন চিকিৎসা।

২) ফার্মাসিউটিক্যাল থেরাপি অর্থাৎ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা।

প্রথমক্ষেত্রে যেটা বলা হয় সুস্থ জীবনযাত্রা, পরিমিত আহার, নিয়মিত শরীরচর্চা বা হাটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করা ধূমপান বর্জন করা ইত্যাদি। আর হেলদি ডায়েট অর্থাৎ চিনি, গুড়, মধু, মিষ্টি, আইসক্রিম, কেক, ঘি, চকোলেট, কোক দৈনন্দিন জীবনে বর্জন করা। তবে ১৫ দিনে একবার একটু ব্যতিক্রমী হলে কোনও অসুবিধা নেই। তবে খেলে অল্প পরিমাণে। অতিরিক্ত কখনওই নয়। সুগারে আক্রান্ত অনেকেরই ধারণা এইসব কিছুই খাব না। তাও একেবারে ঠিক নয়। দরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করা। আমাদের বুঝতে হবে যিনি সুগারের রোগী তার কতটা পরিমাণ ক্যালরি দরকার।

১) রোগী যদি অল্পবয়স্ক পুরুষমানুষ হন এবং খেলাধুলা করেন বা তাকে প্রচুর কায়িক শ্রম করতে হয় তাহলে তার ক্যালরির চাহিদা অনেকটাই বেশি।

২) আবার যদি ষাটোর্ধ রোগী হন, ঘরে বসেই মূলত জীবন কাটান তাহলে তাঁর ক্যালরির চাহিদা তুলনায় অনেকটাই কম হবে। আমরা সেই বুঝেই ডায়েট চার্ট বানাই তাতে ১৪০০ থেকে ২০০০ কিলো ক্যালরি থাকে যার যেমন চাহিদা সেই অনুযায়ী। সম্ভব হলে নিয়মিত ফল খাওয়া যেতে পারে। যেমন আপেল, পেয়ারা, মোসাম্বি লেবু, ন্যাশপাতি, কালোজাম ইত্যাদি।

ওষুধ ছাড়া চিকিৎসার মধ্যে পড়ছে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, শরীরচর্চা করা এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস। এরপরে দ্বিতীয় ধাপে আছে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা। শুরুতে আমরা মেটফরমিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করি, যদি কোনও রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না দেখা যায়। তারপরে আমরা প্রয়োজনমতো অন্যান্য ওষুধ দিই যেমন মালফোনিল ইউরিয়া, পায়োগ্লিটাজোন, পায়োজলিড ইনটায়োনস, GLP অ্যানালগ ইত্যাদি। এছাড়াও আরও অন্যান্য ওষুধ দেওয়া হয় প্রয়োজনমতো। সম্প্রতি একটি নতুন ওষুধ এসেছে SGLT- 2 inhibitors, এই ট্যাবলেট গুলির ব্যবহার সুগার নিয়ন্ত্রণ করার সঙ্গে সঙ্গে হার্টকেও সুরক্ষা দেবে। এরপরে রয়েছে ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা। এবারে কার কতটা ইনসুলিন লাগবে তা চিকিৎসকরাই ঠিক করে দেন। অনেকে মনে করেন ইনসুলিন নেওয়া মানে রোগটা খুব বেড়ে গিয়েছে তা কিন্তু নয়। আমাদের অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিনই নির্গত হয়, শরীরে সুগারের ভারসাম্য বজায় রাখতে। অনেক সময় ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে সুগারের মাত্রা কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়, সেটাও ঠিক নয়। তাই দরকার সঠিক মাত্রার ওষুধ। একটু ডায়াবেটিক এডুকেশন জরুরি রোগী এবং রোগীর বাড়ির লোকজনদের।

সাবধানতা:

আমরা বলি অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার না খাওয়া, সুষম আহার করা, নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া, পায়ের যত্ন নেওয়া, পায়ের নীচে কোনও ক্ষত বা কাটা থাকলে যথাযথ চিকিৎসা করা, পায়ের অসাড় বোধ করলে তা ঠিক সময়ে নজর করা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। পেটে একই জায়গায় ইনসুলিন না নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেওয়া, যাতে জায়গাটা শক্ত হয়ে না যায় বা কোনও ধরনের সংক্রমণ না হয়। এই সব সাবধানতা নেওয়া ছাড়াও নিয়মিত ব্যবধানে রক্তের গ্লাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন (Hb A1,C) পরীক্ষা করা দরকার। প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন বার হচ্ছে কিনা তাও পরীক্ষা করা দরকার। রক্তে সুগারের মাত্রা, রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্র, ওজন ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ডায়াবেটিস নিয়েও দীর্ঘ দিন কার্যক্ষম জীবন কাটানো সম্ভব।