ব্লাডপ্রেশার থেকে হার্টের অসুখ

উচ্চরক্তচাপ এবং হার্টের সমস্যার মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের হৃদযন্ত্রের পেশিগুলিকে রক্ত পাম্প করে বের করার জন্য বেশি জোর দিতে হয়। ফলে হার্টের পেশিগুলি মোটা হয়ে যায়। হার্টের পেশির এই অবস্থাকে বলে লেফট ভেন্ট্রিকুলার হাইপারট্রফি। হৃদযন্ত্রের পেশির বৃদ্ধি হওয়ার নানা বিপদের মধ্যে অন্যতম হল ফাইব্রোসিস বা হার্টের দেওয়াল মোটা হওয়ার মতো সমস্যা। এছাড়া পেশির বৃদ্ধি ঘটলে, তার মধ্যে রক্তের চাহিদা বেড়ে যায়। এর থেকে হতে পারে ইস্কিমিয়ার মতো হার্টের বিবিধ রোগ। এর থেকে বেড়ে যায় হার্ট ফেলিওর এবং হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা।

হার্ট ফেলিওর-

প্রয়োজন অনুসারে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত সরবরাহ করাই হল হৃদপিণ্ডের কাজ। শরীরের প্রয়োজন অনুসারে হৃদপিণ্ড এই কাজে অপারগ হলে তখন সাধারণ ভাবে তাকে হার্ট ফেলিওর বলা হয়। সাধারণভাবে লক্ষণ হল শ্বাসকষ্ট ও ক্লান্তি।

রক্তচাপ থেকে হওয়া হার্ট ফেলিওরকে বর্তমানে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত হল, ডায়াস্টোলিক হার্ট ফেলিওর, এবং দ্বিতীয়ত সিস্টোলিক হার্ট ফেলিওর।

ডায়াস্টোলিক হার্ট ফেলিওর: রক্তচাপের প্রভাবে হার্টের ভিতরের দেওয়ালের প্রসারণশীলতা কমে যায়। শক্ত হয়ে পড়ে। প্রতি হৃদস্পন্দনে হার্টের যতটুকু প্রসারিত হওয়ার দরকার ছিল, ততটা প্রসারিত হতে পারে না। এর ফলে যে পরিমাণ রক্ত হার্টে প্রবেশ করা দরকার ততটা প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। এরপর যখন হৃৎপিণ্ড সংকুচিত হয় তখন যে পরিমাণ রক্ত পরিবহণ হয়, তা শরীরের চাহিদার তুলনায় অনেকটাই কম। কারণ এমনিতেই স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় রক্ত হৃদপিণ্ডে কম প্রবেশ করে। তাই সংকুচিত হলে স্বাভাবিকের তুলনায় কম রক্তই বেরবে! এই সমস্যা থেকে থেকে ফুসফুসের রক্তজালিকায় রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ক্লান্তিবোধ হয়। কোনও ব্যক্তির বিশ্রামরত অবস্থাতেও এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সিস্টোলিক হার্ট ফেলিওর: এই সমস্যায় রক্তচাপের প্রভাবে হৃদপিণ্ডের আকার বেড়ে যায়। হার্টের পাম্প করার ক্ষমতায় ঘাটতি হয়। প্রতি হৃদস্পন্দনে দরকার মতোই রক্ত হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করে। তবে হার্টের আকার বেড়ে যাওয়ায় হার্টের স্বাভাবিকভাবে সংকুচিত হওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে সুস্থ অবস্থায় যতটা পরিমাণ রক্ত হৃদপিণ্ড থেকে বেরত, ততটা পরিমাণ রক্ত বেরয় না। এর দরুণ শরীরের সবভ্রয়গায় প্রয়োজন মতো রক্ত পৌঁছতে পারে না। একে হার্ট ফেলিওর উইত রিডিউসড ইজেকশন ফার্কশন বলে।

ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ ও হার্ট অ্যাটাক: হৃদপিণ্ডের পেশিতে রক্ত সরবরাহে ঘাটতি হলে তাকে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ বলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর মূল কারণ হল হদযন্ত্রের করোনারি ধমনিতে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস হওয়া। প্রশ্ন হল অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস কী? দীর্ঘদিন ধরে ধমনির ভিতরের দেওয়ালে চর্বিজাতীয় পদার্থ এবং কোলেস্টেরল জমে যায়। একে বলে প্লাক। এই প্লাকের কারণে রক্তবাহী নালি সরু ও শক্ত হয়ে যাওয়াকেই অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস বলে।

প্লাকের ফলে ধর্মানি আংশিক বন্ধ হলে হয় অ্যানজাইনা। আর পুরোপুরি বন্ধ হলে রোগী আক্রান্ত হন হার্ট অ্যাটাকে (মায়োকার্ডিয়াম ইনফার্কশন)।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। জলের পাইপের মধ্যে জলের প্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্য নলটি হওয়া দরকার বাধাবিহীন। পাইপের কোথাও কোনও বস্তু আটকে বন্ধ হয়ে থাকলে জলপ্রবাহ কমে যায় বা থেমে যায়। তেমনি হৃপিণ্ডের পেশিতে রক্তসরবরাহকারী করোনারি ধমনির এবং ধমনির শাখা-প্রশাখাগুলিকেও হতে হবে প্রতিবন্ধকহীন। মুশকিল হল, প্লাক জমে থাকলে রক্তনালির ভিতরের দেওয়াল সরু হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে রক্তপ্রবাহ বাধা পায়। ফলে হৃদপিণ্ডের পেশিগুলিতে প্রয়োজনীয় রক্ত পায় না এবং বিভিন্ন উপসর্গ তৈরি হয়। হয়। এর মধ্যে প্রধান হল অ্যানজাইনা এবং হার্ট অ্যাটাক।

অ্যানজাইনা সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া ভালো। দৌড়ানো, সিঁড়ি ভাঙার মতো কাজ করার সময় হৃৎপিণ্ডকে দ্রুত ব্লাড পাম্প করতে হয়। সেই সময় হৃৎপিণ্ডের পেশিতে বেশি পরিমাণ অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্তের প্রয়োজন পড়ে। এদিকে ধমনিতে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের কারণে পেশিতে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। রোগী বুকে ব্যথা এবং অস্বস্তি বোধ করেন। একে বলে অ্যানজাইনা।

একইভাবে ধমনির মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের পেশিতে রক্তপ্রবাহ সম্পূর্ণ থেমে গেলে হার্টের পেশির কোষগুলি মারা যেতে শুরু করে। বুকে প্রবল ব্যথা শুরু হয়। একে বলে হার্ট অ্যাটাক। ঠিকসময়ে চিকিৎসা শুরু না করলে হৃদযন্ত্র সম্পূর্ণ বিকল হয়ে রোগীর প্রাণহানি ঘটতে পারে।

অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস কেন হয় তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে সাধারণভাবে অ্যাথেরোস্ক্রেরোসিস হওয়ার পিছনে যে ক’টি কারণ দায়ী থাকে সেগুলি হল- অতিরিক্ত হারে তৈলাক্ত খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান, মদ্যপান, শরীরচর্চা না করা, স্থূলত্ব এবং অতি অবশ্যই উচ্চ রক্তচাপ। এছাড়াও অন্যান্য কারণ তো রয়েইছে।

মনে রাখুন-

• হার্ট অ্যাটাকের পর একজন রোগী কত দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন তা নির্ভর করে রক্তচাপের উপর। সাধারণত যাঁর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও হার্ট অ্যাটাক হয়, তিনি দ্রুত সেরে ওঠেন। অন্যদিকে যাঁর রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে এবং হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়েন, তাঁর সেরে উঠতে দেরি হয়। তাই সবার উচিত কমবয়স থেকেই রক্তচাপ নিয়ে সতর্ক থাকা। চল্লিশ বছর বয়সের পর প্রতিমাসে রক্তচাপ পরীক্ষা করান। রক্তচাপ রাখুন ১২০/৮০। তবে ওজন বেশি থাকলে ৩০ বছর বয়স থেকেই ব্লাডপ্রেশার পরীক্ষা করান। বিশেষ করে জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসের দিকে নজর দিন। রান্নায় নুনের ব্যবহার কমান। কমিয়ে দিন তেলের পরিমাণ। কার্বোহাইট্রেট জাতীয় খাদ্য কমাতে হবে।

• শরীর চর্চা খুব জরুরি। একদিন সকালে গা ঝাড়া দিয়ে উঠুন। শরীরচর্চা শুরু করুন। ওজন ঝরান। স্থূলত্ব কমান। দেখতেও ইয়ং লাগবে, ব্লাডপ্রেশারও কমে যাবে। ডায়াবেটিস থাকলে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ থাকুন। স্মোকিং বন্ধ করুন। কোলেস্টেরল বেশি থাকলে ওষুধ খান। সবচাইতে ভালো হয় সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন দ্রুতবেগে গা ঘামিয়ে হাঁটুন।

• প্রিহাইপারটেনশন থেকে সতর্ক হতে হবে। কারও রক্তচাপ দীর্ঘদিন

১২০/৮০ এর ওপরে এবং ১৪০/৯০ এর নিচে থাকলে তাকে বলে প্রিহাইপারটেনশন। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে রক্তচাপ স্বাভাবিক করুন।