হৃৎপিণ্ড যে চাপে ব্রেনের দিকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত ঠেলে দেয়, সেই পরিমাণ চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ব্রেনের থাকে না। ব্রেন তাই ধমনি ও শিরাগুলিকে জালিকার আকারে সাজিয়ে নেয়। এই জালিকার মধ্যে রক্ত ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে ব্লাড প্রেসার অনেকটা কমে যায়। এখন কোনও ব্যক্তির ব্লাড প্রেসার বাড়তে শুরু করলে এবং তা নিয়ন্ত্রণ না করলে ব্রেনের এই নিজস্ব জালিকা ব্যবস্থার এবং ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। বাড়তে থাকে স্ট্রোকের ঝুঁকি। আর ব্লাড প্রেসার অন্যতম বড় কারণ হল রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য।
স্ট্রোকের ধরন-
স্ট্রোক দু’ধরনের হয়। ইস্কেমিক আর হেমারেজিক স্ট্রোক।
ইস্কেমিক: এই ধরনের স্ট্রোক দু’ভাবে হয়। প্রথমত, দিনের পর দিন অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের কারণে রক্তনালির দেওয়ালগুলি শক্ত হতে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছনোর আগে ধমনিগুলির স্বাভাবিক প্রসারণশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রক্তনালিতে বহুদিন ধরে প্লাক বা কোলেস্টেরল জমে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় জমে থাকা এই প্লাকে ধাক্কা খেয়ে রক্তপ্রবাহ যাতে বাধা না পায়, সেজন্য রক্তনালি প্রসারিত হয়ে রক্ত সঞ্চালনের পথ সুগম করে। কিন্তু নদীর বুকে জেগে থাকা পাথরে যেভাবে নদী ধাক্কা খায়, সেভাবেই রক্তনালির প্লাকে রক্তপ্রবাহ বার বার ধাক্কা খায়। রক্তে থাকা বিশেষ উপাদান প্লাকে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায় ও প্লাকের জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে (সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস)। একসময় জমাট রক্তের আকার বেড়ে গিয়ে গোটা রক্তনালিটির মুখই বন্ধ করে দেয়। মস্তিষ্কের ধমনিতে এমন হলে তখন ওই ধমনি সন্নিহিত মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের কোষগুলিতে রক্ত পৌঁছয় না। আর রক্তের সঙ্গে থাকে অক্সিজেন আর কোষের খাদ্য। ফলে খাদ্য ও অক্সিজেনের অভাবে কোষগুলি মারা পড়তে থাকে।
দ্বিতীয়ত, প্লাকের কারণে হার্টের ধমনিতেও রক্ত জমাট বাঁধে। ছোট ছোট জমাট রক্তের কণা তৈরি হয় হার্টের চেম্বারে। সেখান থেকে এগুলি আবার রক্তপ্রবাহের সঙ্গে মস্তিষ্কের অন্দরে থাকা সূক্ষ্ম রক্তনালিতে পৌঁছে রক্তপ্রবাহের পথ আটকে দেয়। সেখান থেকেও স্ট্রোক হয়। রক্ত জমাট বেঁধে এইভাবে স্ট্রোক হয় বলে ইস্কিমিক স্ট্রোককে থ্রম্বোটিক স্ট্রোকও বলে।
হেমারেজিক স্ট্রোক: ব্লাড প্রেসার বাড়লে আমাদের শরীরের রক্তবাহী নালিগুলি প্রসারিত হতে থাকে। এভাবেই আর্টারিগুলি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এখন ব্লাড প্রেসার দিনের পর দিন অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকলে আর্টারির দেওয়াল গুলি শক্ত হতে থাকে। রক্ত প্রবাহের সময় যে চাপ তৈরি হয় দেওয়ালের তা সহ্য করার ক্ষমতা কমতে থাকে। এভাবেই সহ্যের চরমসীমায় পৌঁছে ধমনি ফেটে যায় ও রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এর ফলে ব্রেনের ওই অংশের কোষগুলিতে রক্তপ্রবাহ থেমে যায়। একে বলে হেমারেজিক স্ট্রোক।
ইস্কেমিক এবং হেমারেজিক স্ট্রোক ছাড়াও মস্তিকে আরও একধরনের স্ট্রোক হয়, একে বলে ট্রান্সজিয়েট ইস্কেমিক অ্যাটাক।
ট্রান্সজিয়েট ইস্কেমিক অ্যাটাক: আগেই বলেছি প্লাকে ধাক্কা খেয়ে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেকসময় এই ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জমাটরক্তের কণা ব্রেনের রক্তনালিতে কিছু সময়ের জন্য আটকে যায়। আবার কিছুক্ষণ পরে ছেড়েও যায়। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ব্রেনে ছোট ছোট স্ট্রোক হতে থাকে। ফলে সামান্য সময়ের জন্য রোগীর মুখ বেঁকে যায়, কথা জড়িয়ে যায়। ফ্রুট ছেড়ে গেলেই শারীরিক সমস্যাগুলো ঠিক হয়ে যেতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ এই সমস্যাগুলিকে গুরুত্ব দেন না। মুশকিল হল, দিনের পর দিন এমন চলতে থাকলে একদিন বড় আকারে স্ট্রোক হয়ে যায়। সুতরাং কোনও লক্ষণই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। এম আর আই করলেই ধরা পড়ে এই ছোট ছোট স্ট্রোকগুলি সম্পর্কে।
স্ট্রোক হওয়ার লক্ষণ-
• শরীরের একদিকে পক্ষাঘাত হয়ে যায়।
• মুখ বেঁকে যায়। কথা জড়িয়ে যায়।
• হঠাৎ করে রোগী হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন।
কারও কথা বুঝতে পারেন না। এক চোখে ঝাপসা দেখার মতো সমস্যা তৈরি
হয়। স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কে রক্তপাত বা হেমারেজ হলে অত্যধিক মাথাযন্ত্রণা, বমি, অজ্ঞান হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। স্ট্রোক হলে প্রাথমিক চিকিৎসা-
• রোগীকে একদিকে কাত করে শুইয়ে রাখুন। কারণ অনেকসময় স্ট্রোক হলে রোগী বমি করে ফেলেন। গলায় বমি আটকে গিয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাশ ফিরিয়ে রাখলে গলায় বমি বা লালা জাতীয় পদার্থ গলায় আটকে যাবে না। রোগীকে দ্রুত অক্সিজেন দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন ও ভালো হাসপাতালে নিয়ে যান।