নিউরোলজিকাল টেস্ট কখন করার প্রয়োজন পড়ে এবং কি কি টেস্ট রয়েছে ?

আমাদের শরীরকে চালনা করছে যে কন্ট্রোল টাওয়ার, তার। দুটি উইং। একটা হল সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম। অর্থাৎ মস্তিত আর স্পাইনাল কর্ড। আর অন্যটি হল পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম। এদের কাজ হল ব্রেন থেকে তৈরি হওয়া ছোট-বড় সব সিগন্যাল, রুটস এবং নার্ভ মারফত শরীরের প্রতিটি কোনে পৌঁছে দেওয়া। এই দুটি উইং-এ কোনও সমস্যা হলে সেসব টেস্ট করা হয় তাকে চিকিৎসা ‘পরিভাষায় নিউরোলজিকাল টেস্ট বলা হয়ে থাকে। তবে এই সব টেস্টের কোনওটাই কিন্তু রুটিন টেস্টের আওতায় আসে না। নির্দিষ্ট কিছু রোগ নির্ণয়ের জন্য এই সব পরীক্ষাগুলি করার প্রয়োজন পড়ে।

নার্ভাস সিস্টেমের রোগের সাতকাহন-

নিউরোলজিকাল সমস্যাগুলিকে চরিত্র বিশেষে সাধারণত সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-

• ভাসকুলার ডিজিজ ডিমায়ালিনেটিং ডিজিজ ইনফেকটিভ ইনফ্লেমেটরি বা প্রদাহজনিত সমস্যা ডিজেনারেটিভ ডিজিজ ব্রেন টিউমার এপিলেপসি। রোগভিত্তিক পরীক্ষা-নিরিক্ষা-

• ভাসকুলার ডিজিজ স্ট্রোককে ভাসকুলার ডিজিজ বলা হয়। এই ধরনের সমস্যায় রোগীর হঠাৎ করেই একটা দিক প্যারালাইসিস হয়ে যায়। কখনও সখনও আবার হাত, মুখ বা শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে রোগী অস্বাভাবিক আচরণ করেন, অসংলগ্ন কথা বলতে থাকেন, অসহ্য মাথা যন্ত্রণার মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে। এই সব ক্ষেত্রে প্রথমে এম আর আই করা হয়। সঙ্গে প্রয়োজন ভিত্তিতে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি ও কিছু ব্লাড টেস্ট করা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, স্ট্রোক দুই প্রকারের। ইসকিনিক এবং হেমারেজিক।

• ডিমায়ালিনেটিং ডিজিজ- এই রোগে মূলত ব্রেন এবং স্পাইনাল কর্ড মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে রোগী ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে যায়। তবে ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা কিন্তু সম্ভব। এক্ষেত্রে যেসব লক্ষণগুলি দেখা যায়, সেগুলি হল- স্ট্রোকের মত হঠাৎ করে না হলেও ‘ওভার দ্য ডে’ রোগীর শরীরের কোনও অঙ্গ বা একটা দিক অবশ হতে শুরু করবে। সঙ্গে ধীরে ধীরে কথা জড়িয়ে যাওয়া, চলতে ফিরতে অসুবিধা হওয়ার মতো সমস্যাগুলি দেখা দেয়। আদৌ এই রোগ হয়েছে কিনা জানতে মূলত এম আর আই এবং লাম্বার পাংচার টেস্ট করা হয়।

• ইনফেকটিভ ডিজিজ সেন্ট্রাল বা পেরিফেরিয়াল নার্ভাস সিস্টেমে কোনও ইনফেকশন হওয়ার কারণে যেসব রোগ হয়, তাকে চিকিৎসা পরিভাষায় ইনফেকটিভ ডিজিজ বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের রোগে মাথায় যন্ত্রণা, সঙ্গে জ্বর, বমি, খিঁচুনি, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। সাধারণত এই সব লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটলে লাম্বার পাংচার টেস্ট এবং এম আর আই করে রোগের উপস্থিতি। সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা করা হয়।

• ইনফ্লেমেটরি বা প্রদাহজনিত সমস্যা- এই ধরনের সমস্যাগুলি সরাসরি নিউরোলজিকাল না হলেও অনেক সময় শরীরের নার্ভাস সিস্টেম আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন কোথায় সমস্যা হয়েছে জানতে ব্লাড টেস্ট এবং এম আর আই করা হয়ে থাকে।

• ডিজেনারেটিভ ডিজিজ- এই রোগে বয়স বারার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেনের শিরা- উপশিরাগুলি শুকিয়ে গিয়ে স্মৃতিশক্তি লোগ পেতে শুরু করে। রোগী সাধারণ কাজটুকুও করতে পারেন না। যেমন, চশমা বা প্রয়োজনীয় কোনও জিনিস রেখে ভুলে যান কোথায় রেখেছেন, চেনার ক্ষমতা কমে যায়, ব্রাশ করা বা খাবার কীভাবে খেতে হয় তা ভুলে যান, খেয়েও বলেন খাইনি, চেনা লোকদের চিনতে পারার ক্ষমতা কমে যায়, যেখানে-সেখানে টয়লেট করে ফেলার মতো দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজ ধীরে ধীরে ব্যহত হতে থাকে। প্রসঙ্গত, ডিজেনারেটিভ ডিমেনশিয়া মূলত দু’ধরনের, অ্যালঝাইমার ডিমেনশিয়া ও ফ্রন্টোটেম্পরাল ডিমেনশিয়া। অ্যালঝাইমার ডিজিজে রোগীর স্মৃতিভ্রম হয়। অন্যদিকে ফ্রন্টোটেম্পরাল ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রাথমিক অবস্থায় ভুলে যাওয়ার মতো সমস্যা হয় না। তাদের চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটে। যেমন- এক কথা বারবার বলা, খাবার খাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া, অকারণে গালমন্দ করা, হঠাৎ করে খুব রেগে যাওয়া, আশালীন আচারণ করা, জামাকাপড় পরতে না পারা, ধীরে ধীরে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা সহ আরও নানা ধরনের লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে মূলত এম আর আই করা হয়। সঙ্গে প্রয়োজন মতো পেট স্ক্যানের মতো পরীক্ষা করাও হয়ে থাকে।

পারকিনসনস ডিজিজকেও ডিজেনারেয়িটভ ডিজিজের আওতায় রাখা হয়। এই রোগ হলে রোগীর হাঁটচলা করতে সমস্যা হয়, কাজ কর্মের গতি কমে যায়। সঙ্গে হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। এক্ষেত্রেও এম আর আই-এর সঙ্গে পেট স্ক্যান করা হয়। • ব্রেন টিউমার- এই রোগে মাথায় যন্ত্রণা, বমি, বমির পর পরই মাথার যন্ত্রণা কমে যাওয়া, সঙ্গে প্যারালিসিস এবং খিঁচুনির মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে এম আর আই এবং এম আর স্পেকটোস্কোপি নামক একটি অত্যাধুনিক টেস্ট করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এইসব টেস্টের পাশাপাশি বায়োপসি করারও প্রয়োজন পরে।

• এপিলেপসি- চলতি কথায় এই রোগটিকে আমার মৃগি নামে চিনে থাকি। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাবে, সঙ্গে খিঁচুনির মতো লক্ষণ দেখা দেবে। এক্ষেত্রে ইই জি এবং এম আর আই- এর মতো পরীক্ষার সাহায্য নেওয়া হয়। আরও কিছু নিউরোলজিকাল রোগ ও তার পরীক্ষা-

• পেরিফেরিয়াল নিউরোপ্যাথি- নার্ভের কোনও সমস্যা হলে তাকে চিকিৎসা পরিভাযায় পেরিফেরিয়াল নিউরোপ্যাথি বলা হয়। এই রোগে হাত-পা ঝিন ঝিন করবে, হাত-পায়ের জোর কমে যাবে, প্যারালিসিস হওয়ার আশঙ্কাও থাকবে। এক্ষেত্রে নার্ভের ‘ফাংশন’ ঠিক আছে কিনা জানতে নার্ভ কনডাকশন স্টাডি করা হয়।

• মায়োপ্যাথি- মাংস পেশির সমস্যাকে মায়োপ্যাথি বলা হয়। এই রোগে আক্রান্ত কিনা জানতে সাধারণত ই এম জি নামক একটি টেস্ট করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে নিউরো মাসকুলার জাংশনে কোনও সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে সাধারণত রিপিটেটেড নিউরো স্টিমুলেশন স্টাডি করা হয়।