ভুঁড়ির সাথে খাওয়ার সম্পর্ক কি?

খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থার আশ্বাস-

আজকাল প্যাকেটজাত খাবারের গায়ে লেখা থাকছে ‘নো অ্যাডেড সুগার’ বা ‘জিরো কোলেস্টেরল’। সত্যি কথা। খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি আজকাল খাবারে চিনি মেশাচ্ছে না। তারা ব্যবহার করছে ফ্রুক্টোজ যা কার্বোহাইড্রেটের অতি সরল রূপ। আসলে আমাদের শরীরে চিনি ঢুকলে তা ভেঙে ফ্রুক্টোজে পরিণত হয়। খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি চিনির বদলে ফ্রুক্টোজ ব্যবহার করছে রসগোল্লা, কোল্ডড্রিংক, সন্দেশে। ফ্রুক্টোজ দ্রুত রক্তে মেশে। লিভারে জমা হয়। যার ফল হল ফ্যাটি লিভার।

আবার জিরো কোলেস্টেরল ট্যাগ দেওয়া খাদ্যে সত্যিই কম কোলেস্টেরল থাকছে। মুশকিল হল, কোলেস্টরল বাদ দিলে খাদ্যের স্বাদ থাকে না। তাই খাদ্যের স্বাদ বজায় রাখতে কোলেস্টরলের বদলে মিশছে চিনি, রাসায়নিক পদার্থ। খাবারের প্যাকেটের গায়ে ইনগ্রেডিয়ন্টস বা কম্পোনেন্টস লেখা অংশে চোখ রাখলেই চোখে পড়বে এই তথ্য। অন্য দিকে রেডিমেড খাবারে থাকছে ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট। দুটোই প্রকারন্তরে একইরকম খারাপ। অথচ খাদ্যে এই ফ্যাট ব্যবহার করলে সেই খাদ্য দীর্ঘদিন পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায়। ট্রান্স ফ্যাট প্লাস্টিকের মতো। এটা মানুষ হজম করতে পারে না। দেহে ফ্যাট হিসাবে সঞ্চিত হতে থাকে। যত ছোট থেকে মানুষ প্যাকেটজাত খাদ্য সেবন করে, তত শরীরে জমতে থাকে ট্রান্স ফ্যাট। ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাট সুস্থমানুষের দেহে ফ্যাটি লিভার, পলি সিস্টিক ওভারি, হার্ট অ্যাচাকের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। কম বয়সেই শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়।

অন্যদিকে বাজারে বাদামি পাঁউরুটি পাওয়া যায়। এগুলি রঙেই ব্রাউন। আসলে ময়দারই তৈরি। গুড় দিয়ে রং করা হয়। তাই হাতে গড়া রুটির কোনও বিকল্প নেই। স্থূলকায় আর ভুঁড়ি কি এক?-

অনেকে ভাবেন, ওজন বাড়লে ভুঁড়ি হয়। এমনটা নাও হতে পারে। কারণ কার ওজন কত হবে তা নির্ভর করে আমাদের দেহের তিনটি বিষয়ের ওপর- মাসল মাস (মাংসপেশির অংশ), বোন মাস (হাড়ের পরিমাণ) এবং ফ্যাট মাস (চর্বির অংশ)।

শরীরে মাসল মাস বা মাংসপেশির পরিমাণ বেশি থাকলে সমস্যা নেই। কারণ পেশিবহুল চেহারা আমাদের সকলেরই ভালো লাগে। বোন মাস বেশি থাকলেও সমস্যা হয় না। হাড় দুর্বল হয় না। মুশকিল হল, কারও শরীরে ফ্যাটের আধিক্য দেখা গেলে ওজন বেড়ে যায়।

তবে আদৌ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওজন আছে কি না তা জানার জন্য আছে বি এম আই বা বডি মাস ইনডেক্স নির্ণয়। বি এম আই জানার উপায় হল (এশিয়ান এবং ভারতীয়দের জন্য)-

ওজন (কেজি)/ উচ্চতা (মিটার স্কোয়ার)। বি এম আই ১৮ থেকে ২৩ এর মধ্যে থাকাই ভালো। ২৩-২৫ এর মধ্যে হলে ওভার ওয়েট। ২৫ এর এর বেশি হলে বুঝতে হয় ওই ব্যক্তি স্থুলত্বের সমস্যায় ভুগছেন। স্থূলকায়দের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমার সমস্যা থাকে।

সাধারণত দেখা যায় মোটা ব্যক্তি মাত্রেই তার ভুঁড়ি আছে। তবে স্থূলকায় হলেই যে ভুঁড়ি থাকবে এমন নাও হতে পারে। বহুক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে দোহারা চেহারার মানুষ স্কুলত্বের সমস্যায় ভুগলেও তার ভুঁড়ি নেই। কারণ ভুঁড়ি হয় শুধুমাত্র পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমে। বহু স্থূলকায়দের সারা শরীরেই সমানভাবে চর্বি জমে। সেই থেকেও তাদের ওজন বাড়তে পারে। আবার বি এম আই ২৫ এর নিচে থাকলেও অনেকের ভুঁড়ি আছে এমন দেখা যায়। এদের হাত পা সরু হয়। কারণ সেখানে ফ্যাটের আধিক্য কম। অথচ পেট মোটা! কারণ এদের সারা শরীরের তুলনায় পেটে চর্বি জমে অনেক বেশি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ওজন বাড়া হোক বা ভুঁড়ি, দুটি ক্ষেত্রেই দায়ী প্রয়োজনের অতিরিক্ত চর্বি।

ফ্যাট কমাতে স্বল্প নয়, সঠিক খান গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুডে বাজার ভরতি হয়ে আছে। এই ফাস্টফুডগুলি দামেও সস্তা, আবার যথেষ্ট মুখরোচক। অথচ অস্বাস্থ্যকর। এদিকে স্বাস্থ্যকর খাবারের দাম বেশি। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, পেট ভরাতে ৮০ টাকা কেজির দুটো আপেল কেনার চাইতে ১৫ টাকার এগরোল সস্তা। অথচ ক্যালরির বিচারে দেখতে গেলে, অ্যাপেলে ক্যালরি থাকে অনেক কম। এগরোলে বেশি। আবার আপেলের পুষ্টিমূল্য এগরোলের চাইতে বহুগুণ বেশি। আর এভাবেই খাদ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কতকগুলো ভুল পদক্ষেপ ঘুরপথে আমাদের ওজনের সঙ্গে ভুঁড়ি সৃষ্টি করছে।

তাই কতকগুলি বিষয় মাথায় রাখুন- • প্যাকেটজাত খাদ্য, রেডিমেড খাদ্য বর্জন করুন। আজকাল প্যাকেটেই ফিঙ্গার চিপস, পট্যাটো চিপস, পনির, মাংস, স্যান্ডউইচ, এমনকী ভাত, রুটি, সবজির থালাও পাওয়া যায়। বোতলে মেলে কোল্ডড্রিংকস। মনে রাখবেন এগুলিতে মেশানো থাকে ট্রান্স ফ্যাট এবং ফ্রুক্টোজ।

• বাড়ির খাদ্য খান। মাসে মাথাপিছু ৫০০ গ্রামের বেশি তেল ব্যবহার করবেন না।

• খাদ্যে শাকসবজির পরিমাণ বাড়ান। শাকসবজি, আটার রুটি খান। মরসুমি ফল খান। যে ফলগুলি খোসা শুদ্ধ খাওয়া যায় সেগুলির খোসা বাদ দেবেন না। এগুলিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন থাকে। ময়দার তৈরি খাদ্য খাবেন না। এতে মোটেই ফাইবার থাকে না। উপরন্তু শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

• অতি অবশ্যই ব্রেকফাস্ট মিস করবেন না। কারণ রাতে সাধারণত আমরা সাত আট ঘণ্টা ঘুমোয়। এই সময় পেট সম্পূর্ণরূপে খালি থাকে। তাই সকালে কিছু না খেয়ে কাজে বেরলে, পেটের জনা ফ্যাট থেকে এনার্জি সংগ্রহ করে শরীর।আর সকালের এই সময়ে পেটের ফ্যাট থেকে বিষের মত ক্ষতিকর পদার্থ বেরয়। যা শরীরের পক্ষে মারাত্মক হানিকারক। তাই ব্রেকফাস্ট করতে তা থেকেই শরীর এনার্জি সংগ্রহ করবে। পেটের ফ্যাট কমাবার জন্য সকালের খাবার খেয়ে শারীরিক পরিশ্রমই হল একমাত্র স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি।

• টিভি দেখতে দেখতে বা কম্পিউটারে কাজ করতে করতে স্ন্যাকসজাতীয় খাবার খাবেন না। এতে ক্যালরি বেড়েই চলে।

• দিনে মোট পাঁচবার খান। বাড়িতে তৈরি স্বল্প তেলে তৈরি রান্না করা খাদ্যে পেটপুরে ব্রেকফাস্ট করুন। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে একটা ফল খান। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে লাঞ্চ করুন। তবে পেটে খিদে রেখে খাবেন। এর ঘন্টা তিনেক পরে বিকেল নাগাদ সামান্য টিফিন করুন। এইসময় চিড়ে মুড়ি খাবেন সামান্য পরিমাণে। রাতের খাবার খান রাত আটটার মধ্যে। সামান্য খাবার খাবেন। কারণ রাতে আমাদের শরীরের যন্ত্রপাতির কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। বেশি রাতে অতিরিক্ত খাবার খেলে তা সঠিকভাবে হজম হয় না। ফ্যাট জমা হয় বেশি। ডিনারের

ঘণ্টাদুয়েক পরে শুতে যান। শারীরিক পরিশ্রমের বিকল্প নেই-

• আগেই বলেছি ভারতীয়দের শরীরে মাংসপেশির পরিমাণ কম। তাই শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি। তাই পেশির পরিমাণ বাড়াতে সুখাদ্য গ্রহণের সঙ্গে ব্যায়াম করতেই হবে। সপ্তাহে পাঁচ দিন, অন্তত ঘন্টাখানেক সময় বার করে ব্যায়াম করতেই হবে। একটানা একঘন্টা সময় বার করতে না পারলে ১৫ মিনিট করে সারাদিনে চারবারে ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রম করুন।

• একটানা ৯০ মিনিটের বেশি বসে থাকলে ওজন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই অফিসে কাজ করার সময় ৯০ মিনিটের পর ১০ মিনিট হাঁটাচলা করে কাজে বসুন।

• মহিলাদের ত্বকের নিচে ফ্যাট জমে বেশি। তুলনায় পুরুষদের পেটের ভিতরে ফ্যাট জমে বেশি। দুটি ক্ষেত্রেই শারীরিক পরিশ্রমই একমাত্র ভরসা।

• অনেকে চেহারা ঝরঝরে দেখাতে লাইপোসাকশন করান। একটা কথা জেনে রাখুন, লাইপোসাকশনে ভিসেরাল ফ্যাট কনে না। এতে শুধু চামড়ার তলার ফ্যাট কমে। এতে প্রাথমিকভাবে দেখতে ভালো লাগলেও শরীরের উপকার হয় না।

• ব্যবস্থা প্রথম থেকেই নেওয়া ভালো। তাই প্রেগন্যান্সির সময়ে প্রোটিনজাতীয় খাবার খাওয়ান ভাবী মাকে। এতে বাচ্চার মাংসপেশি সুগঠিত হবে। এতে বড় হওয়ার পর শরীরে ফ্যাট জমবে কম। ভুঁড়ি আছে কিনা জানার সহজ উপায়- ফিতে দিয়ে নিজের পেটের মাপ নিন। ভুঁড়ির বেড় ছেলেদের জন্য ৯০ সেন্টিমিটার ও তার বেশি হলে বুঝতে হবে ভুঁড়ির সমস্যা আছে। মেয়েদের ৮০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পেটের বেড় তার দৈহিক উচ্চতার অর্ধেক হলে বুঝতে হবে বাচ্চাটিরও ভুঁড়ি হয়েছে।