কারণ ও নিরাময়
ঘাড়, কোমর এবং হাঁটু ব্যথার কারণ মানব শরীরের এই অংশগুলি বিভিন্ন হাড়, পেশি, টেন্ডন, লিগামেন্ট এবং অন্যান্য সব টিস্যু সমন্বয়ে গঠিত। কোনও কারণে এই হাড়, পেশিগুলি বা অন্য কোনও টিস্যু আঘাতপ্রাপ্ত হলে, ক্ষয়ে গেলে অথবা অতিচাপে স্থানচ্যুত হলে আমাদের ব্যথা অনুভূত হয়। শরীরের কোনও একটি অঙ্গে ব্যথা হওয়ার নেপথ্যে থাকতে পারে অনেকগুলি কারণ।
• পশ্চারাল ডিসফাংশন অ্যান্ড ইনকারেক্ট পজিশনিং সেন্স-
শরীরে এই অংশগুলিতে ব্যথা হওয়ার অন্যতম কারণ সঠিক দেহভঙ্গি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকা। শোওয়া, হাঁটা, বসা এবং দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ ইত্যাদি করার সময় শরীরের অবস্থানকে দেহভঙ্গি বলা হয়ে থাকে। আর এখানেই যত সমস্যা। কোন কাজ করার সময় কোন অবস্থানে শরীরকে রাখলে শরীরে চাপ পড়ে না বা সমস্যা হয় না, তা আমাদের বেশিরভাগেরই জানা নেই। বিষয়টিকে একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, ধরা যাক কোনও এক ব্যক্তি প্রতিদিন বালতি করে জল তুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যান। এতটা পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই। তবে হঠাৎ একদিন উনি কোমরে ব্যথা অনুভব করলেন। এরপর সমস্যা না কমাতে ডাক্তারবাবুর কাছে আসলেন। রোগীর সঙ্গে কথা বলে ডাক্তারবাবু আবিষ্কার করলেন লোকটির বালতি তোলার পদ্ধতিতেই সমস্যা আছে। আসলে লোকটি মাটি থেকে বালতিটি দাঁড়িয়ে তোলেন। এতেই তাঁর কোমরে সমস্যা দেখা দিয়েছে। পা দুটিকে ভাঁজ করে একটু নিচু হয়ে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বালতির কাছে শরীরকে নিয়ে গিয়ে বালতি তুললে তাঁর সমস্যা হত না। এই মানুষটি আলাদা কেউ নন, এরকম হাজারো ভুল প্রতিদিনই আমি আপনি করেই থাকি। দেহভঙ্গির এই সাধারণ ভুলগুলির ফলাফল হিসাবে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হতেই পারে।
• অকুপেশনাল- বিভিন্ন ধরণের পেশার মানুষের শরীরের নানা স্থানে ব্যথা হতে পারে। ধরা যাক কোনো ব্যক্তিকে পেশার কারণে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার কাউকে পেশাগত কারণে দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করতে হয়। এই সকল ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা অন্যান্যদের থেকে অনেক বেশি।
• মানসিক চাপ বা স্ট্রেস- হ্যাঁ মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের জন্য শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথার জন্ম নিতে পারে। আসলে মানসিক চাপ আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে বাধার সৃষ্টি করে এবং পরোক্ষ ব্যথা দেখা দেয়। আবার অন্যদিকে রয়েছে ক্রনিক ব্যথার রোগীরা। এই সকল রোগী নিজেদের ব্যথা সম্পর্কে অতিরিক্ত চিন্তা করে ব্যথাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারেন।
• মেকানিক্যাল অ্যান্ড অ্যাক্সিডেন্টাল- ধরা যাক আপনি বাসে করে কোথাও যাচ্ছেন। এই সময় হঠাৎ করে বাসের ঝাঁকুনিতে আপনার ঘাড়ে ব্যথা লাগল। সেক্ষেত্রে এটিকে মেকানিক্যাল পেইন বলা যেতেই পারে। আবার বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণেও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা লগাতে পারে।
• এছাড়া অতিরিক্ত ওজন, ডায়েট চার্টে অপর্যাপ্ত ক্যালশিয়াম এবং ভিটামিনের ঘাটতি, ইনফেকশন ইত্যাদির ফলেও ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ব্যথা কাদের বেশি হয়?
এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল বয়সের মানুষেরই ব্যথার সমস্যা হয়ে থাকে। তবে হাঁটুর ক্ষেত্রে পুরুষদের ৪৫-৫০ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪০-৪৫ বছরের পরে এই ব্যথার লক্ষণ বেশি দেখা যায়। অথচ আধুনিক সমাজে অনেক কমবয়সিদের, এমনকী ছোটদেরও এই সমস্যগুলি হতে পারে। আর লিঙ্গগত দিক দিয়ে বললে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই সমস্যাগুলিতে ভোগার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে।
এক্সারসাইজের মাধ্যমে কি এই ব্যথা কমানো সম্ভব?
আসলে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার একটি তাংশ হল এক্সরাসাইজ বা ব্যায়াম। সঠিক চিকিৎসা এবং ব্যায়ামের যুগলবন্দীতে ভালো থাকা যায়। এবার একে একে ঘাড়, কোমর এবং হাঁটু ব্যথা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
• ঘাড়ে ব্যথার ব্যায়াম-
• এক্ষেত্রে প্রথমে বাবু হয়ে বসুন বা পা ঝুলিয়ে বসুন। মেরুদণ্ড এবং ঘাড় সোজা রাখুন। এবার দুটি হাতের আঙুলগুলিকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসুন। এরপর একহাতের আঙুলের মাঝে অপর হাতের আঙুল প্রবেশ করিয়ে লক করে দিন। তবে খোলা বইয়ের মতো হাতের তালু উন্মুক্ত রাখুন। এক তালুর উপর অন্য তালু চেপে বসাবেন না বা মুষ্টিবদ্ধ করবেন না। এরপর আঙুলগুলি লক করা দুইহাতের তালু রাখুন কপালে। আঙুলগুলি রেখে হাতের জোরে কপালটিকে পিছনের দিকে ঠেলুন। অন্যদিকে আবার ঘাড়ের মাধ্যমে সমপরিমাণ বল প্রয়োগ করে ঘাড়টিকে সোজা রাখুন। অর্থাৎ মাথাকে আঙুল দিয়ে পিছনে এবং ঘাড় দিয়ে সামনে ঠেলুন। এতে সমান এবং বিপরীত ক্রিয়ায় ঘাড় নির্দিষ্ট স্থানেই থাকবে। এটা গেল এক। এবার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হাতের তালু আগের মতোই জোড় অবস্থায় রেখে মাথার পিছনে রাখুন। এবার ঠিক উলটো রকম। অর্থাৎ হাতের মাধ্যমে মাথাকে পিছনে ঠেলুন এবং ঘাড়ের শক্তি প্রয়োগ করে সেই চাপ ব্যালেন্স করে ঘাড়টিকে নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন। এভাবে প্রতিটি পদ্ধতি দশ সেকেন্ড ধরে করতে হবে। দুটি পদ্ধতি একবার একবার অদলবদল করে দশ বার করে দিনে তিন বার করুন। তবে এই ব্যায়াম করার আগে নির্দিষ্ট স্থানে একটু গরম জলের সেঁক করে নিলে ভালো উপকার পাবেন।
• এই ব্যায়ামের পদ্ধতিটি খুবই সহজ।
প্রথমে মেরুদণ্ড এবং ঘাড় সোজা রেখে বসতে হবে। এবার মাথা সোজা রেখে সামনের দিকে তাকান। তারপর একবার মাথাটিকে বামদিকে ঘোরান। আবার একইভাবে মাথাটিকে ডানদিকে ঘোরান। তবে খেয়াল রাখবেন ঘাড় যেন সোজা থাকে। এভাবে দশ বার করে দিনে দুই থেকে তিনবার করতে হবে।
• পরামর্শ-তবে শুধু ব্যায়াম নয়,
এক্ষত্রে আরও কিছু সাধারণ কৌশলের প্রয়োগ করলেও ভালো থাকা যায়। যেমন কম্পিউটারের সামনে কাজ করলে কম্পিউটারের মনিটরকে ঘাড়ের সমান উচ্চতায় নিয়ে আসতে হবে। কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত সাপোর্ট পাওয়া যায় এমন চেয়ার ব্যবহার করতে হবে। বেশিক্ষণ ঘাড় নিচু করে কাজ করা চলবে না।
• কোমরে ব্যথার ব্যায়াম-
• মাথা উপর দিকে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন। এবার যেকোনও একটি পা মাটি বা বিছানা থেকে ছয় ইঞ্চি উপরে তুলতে হবে। পা তোলা অবস্থায় পায়ের পাতাটিকে পিছনের দিকে অর্থাৎ মাথার দিকে টানুন। তবে হাত ব্যবহার করা যাবে না। পায়ের বলেই পায়ের পাতাকে যতটা সম্ভব পিছনের দিকে টানতে হবে। এভাবে দশ সেকেন্ড পা ওই অবস্থায় ধরে রাখতে হবে। একবার বাঁ পা এবং তারপর ডান পা, এইভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ১৫ বার করে দিনে তিনবার করুন। কিছুদিন গেলে ওই একই জিনিস ১৫ বারের পরিবর্তে ২০ বার করে করুন। এর থেকেও ভালো অবস্থায় পৌঁছলে, মাটি থেকে দুটি পা একসঙ্গে তুলে নিয়ে সেই একই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি করুন।
• পরামর্শ বেশি নিচু হয়ে কাজ করা চলবে না। মাটিতে যত কম বসা যায় ততই ভালো। গাড়িতে গেলে ‘জার্কি মুভমেন্ট’ এড়িয়ে চলুন। মেরুদন্ড সোজা রেখে বসুন। কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত সাপোর্ট দেওয়া চেয়ার ব্যবহার করুন। উঁচুনিচু রাস্তা এড়িয়ে চলুন।
• হাঁটু ব্যথার ব্যয়াম-
• এক্ষেত্রে প্রথমে একটি চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসুন। এবার যেকোনও একটি পাকে যতটা সম্ভব উপরে তুলুন। আদর্শ হল কোমর পর্যন্ত সোজা ভাবে পা রাখা। অনেকটা ইংরেজির ‘L’ অক্ষরের মতোন। তবে হাতের সাহায্য এক্ষেত্রেও নেওয়া চলবে না। এবার এই অবস্থাতেই দশ সেকেন্ড থাকুন। এভাবে একবার বাঁ পা এবং ডান পা করে ১৫ বার করে দিনে দুই থেকে তিন বার করুন। একটু ভালো অবস্থায় এলে পায়ের গোড়ালিতে এক থেকে দুই কেজি ওজন বেঁধে ওই একই পদ্ধতিতে করতে থাকুন। • পরামর্শ- বাবু হয়ে বসার অভ্যাস থাকলে ছাড়তে হবে। মাটিতে বসা চলবে না। অসমতল স্থানে হাঁটা চলবে না। চেষ্টা করবেন বেশি দাঁড়িয়ে না থাকার। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তিনি আপনাকে সঠিক পদ্ধতি বলে দেবেন। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ না নেওয়া পর্যন্ত সিঁড়ি ভাঙতে যাবেন না।
তবে এইগুলি সাধারণ কিছু ব্যায়াম। এটা চিকিৎসা নয়। এর থেকে আরও আধুনিক কিছু পদ্ধতি আছে। তবে সেই সকল পদ্ধতিগুলি রোগভেদে ভিন্নভিন্ন রকমের হয়। তাই ব্যথার সূত্রপাত হলেই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তিনিই। আপনাকে সঠিক উপায় বলে দেবেন। আর পরামর্শ না নেওয়া পর্যন্ত এই ব্যায়ামগুলি করলে ভালো থাকবেন।