ডায়াবেটিসে ভোগা রোগীদের জন্য যে খাদ্য নির্বাচন করা হয় তাকে অনেকে বলেন ‘ডায়াবেটিক ডায়েট’। ডাক্তার বলেন, আলাদা করে ডায়াবেটিক ডায়েট বলে কিছু হয় না। সুগারের রোগীদের সুস্থ থাকতে স্বাস্থ্যকর খাদ্য বা হেলদি ডায়েটের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, যে খাবারে সমস্ত রকম পুষ্টিগুণ আছে সেই ধরনের খাদ্য। তবে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুধু ডায়েট কন্ট্রোলে কাজ হবে না। সঙ্গে এক্সারসাইজ করা দরকার। তবেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যাবে। ডায়াবেটিসের রোগীরা বারবার একটাই অভিযোগ করেন। তাদের নাকি চিনি, গুড়, মধু, আইসক্রিম, চকোলেট, কেক, রসগোল্লা, সন্দেশের মতো মিষ্টিজাতীয় খাবার সারাজীবনের মতো নিষিদ্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। তাই তারা লুকিয়ে লুকিয়ে এগুলি খান। আসলে রোগীরা বুঝতে পারেন না কেন তাদের এই ধরনের খাবার বর্জন করতে বলা হয়। আসলে এই ধরনের খাদ্য যে কোনও ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে চরম ক্ষতিকর। কারণ এই খাদ্যগুলি হুট করে রক্তে সুগারের মাত্রা চড়িয়ে দেয়। বারংবার এমন হলে ডায়াবেটিসের রোগীর পক্ষে তা চরম ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। আমরা তাই রোগীর পরিজনদের বলি, রোগী এইধরনের মিষ্টি জাতীয় খাদ্য, আইসক্রিম, বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করলে তাকে খাদ্যগুলি দিন। তবে কখনই নিয়মিত নয়। অন্তত পক্ষে একমাস পরে পরে। আবার একমাস পরে খাচ্ছেন বলে ডায়াবেটিক মানুষটি একসঙ্গে অনেকটা বিরিয়ানি, মাংস বা অনেকগুলি মিষ্টি, চকোলেট, আইসক্রিম খেতে পারেন না কখনও। খাবারগুলি অতি অল্প পরিমাণে খেতে হবে। রসগোল্লা খেতে ইচ্ছা হলে একটা খাবেন মাসখানেক পরে। দুটো কখনই নয়। এতে একইসঙ্গে রসনা এবং মন- দুইয়েরই তৃপ্তি লাভ হবে। আবার নিয়ম ভাঙতে হবে না।
আসলে ডায়াবেটিস অসুখটাই এমন যে বেশ কতকগুলি খাবার মেপে খেতে হয়। কিছু খাদ্য এড়িয়ে চলতে হয়। এতে আখেরে রোগীদেরই লাভ।
এখন রোগীদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ডাক্তারবাবু কেন এমনভাবে খাদ্যগ্রহণে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন?
ডায়াবেটিকদের ডায়েট এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পিছনে দায়ী থাকে খাদ্যের গ্লাইসেমিক লোড এবং গ্লাইসেমিক ইনডেক্স।
গ্লাইসেমিক লোড- ১০০ গ্রাম খাদ্যে ক্যালরির (এনার্জি)পরিমাণই হল সেই খাদ্যের গ্লাইসেমিক লোড। প্রত্যেক খাদ্যের গ্লাইসেমিক লোড আলাদা হয়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরা যাক ১০০ গ্রাম গ্লুকোজে ক্যালরি আছে ১০০। অথচ ১০০ গ্রাম তরমুজে ক্যালরি আছে ১৬।
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কোনও খাদ্য খাওয়ার পর, সেটি কত দ্রুত ভেঙে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি করে- সেটিই হল ওই খাদ্যের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরা যাক, ১০০ গ্রাম গ্লুকোজে ক্যালরির পরিমাণ ১০০। আর ১০০ গ্রাম আটার রুটিতেও ক্যালরির পরিমাণ ১০০। অথচ ১০০ গ্রাম গ্লুকোজ ১ মিনিটের মধ্যে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ১০০ গ্রাম আটার রুটি খেলে রক্তে গ্লুকোজ মিশবে ধীরে ধীরে। এর কারণ হল, আটা হল কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট।
ফলে আটায় থাকা শর্করা থেকে গ্লুকোজ অনেক ধীরে ধীরে ভাঙবে। এতে রক্তে সুগারের মাত্রার চট করে হেরফের ঘটবে না। অন্যদিকে রসগোল্লায় যে কার্বোহাইড্রেট থাকে তা সিম্পল কার্বোহাইড্রেট বা সরল প্রকৃতির শর্করা।
ফলে সরাসরি রসগোল্লার গ্লুকোজ রক্তে যাবে মিশে। এতে রক্তে হুট করে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যাবে। ব্লাড সুগারে গন ঘন এইরকম পরিবর্তন হলে নানা ধরনের জটিল শারীরিক সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এই কারণেই আমরা সুগারের রোগীদের সেই সমস্ত খাদ্য এড়িয়ে যেতে বলি, যেগুলোর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক বেশি।
চিকিৎসকরা চান, ডায়েটে যেন গ্লাইসেমিক লোড এবং ইনডেক্সের মধ্যে একটা সমতা থাকে। মোট কথা চিকিৎসকরা সেই ধরনের খাদ্য গ্রহণ করতে বলেন যেগুলিতে গ্লাইসেমিক লোড এবং ইনডেক্স দুটোই কম থাকে। এখানেও একটা উদাহরণ দিলে ভালো হয়-
১০০ গ্রাম তরমুজে ক্যালরি আছে ১৬। শসাতে আছে ১০। ক্যালরি প্রায় সমান সমান। অথচ তরমুজের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭৫। শসার ১৫। তাই বলে কি তরমুজ খাওয়া যাবে না? নিশ্চয় খাওয়া যাবে। কারণ ক্যালরি খুবই কম থাকে তরমুজে।
অনেক খাবার আছে যার মধ্যে গ্লাইসেমিক লোড বেশি থাকলেও ইনডেক্স কম। সেই ধরনের খাদ্য রোগীকে খেতে দেওয়া যায়।
ক্যালরি-
এরপর দেখতে হবে রোগীর সারাদিনে কত ক্যালরির প্রয়োজন। সবার একই পরিমাণ ক্যালরির খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। কারণ সবাই একই ধরনের কাজ করেন না। কারও কাজে কায়িক শ্রম লাগে, যেমন অ্যাথলিট। আবার কেউ শুধু অফিসের ডেস্কের পিছনে বসে থাকেন।
শারীরিক খাটাখাটনি করলে এনার্জি ক্ষয় হয় বেশি। অন্যদিকে যাদের অফিসে বসেই কাজ করতে হয় তাদের এনার্জি লাগে কম। স্বভাবতই ক্যালরির প্রয়োজনও হয় কম। তবে ‘ক্যালরি’ তো আর খাওয়া যায় না। আমরা খাই খাদ্য। সেই খাদ্যে থাকে ক্যালরি। তাই চিকিৎসক দেখে নেন, রোগীর সারাদিনে কত ক্যালরি খাদ্যের প্রয়োজন।
সেই বুঝে রোজকার খাদ্যবস্তু এবং খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করেন। এছাড়াও বয়স ভেদেও ক্যালরির তারতম্য ঘটতে পারে। তারতম্য ঘটে সন্তানসম্ভবা মহিলাদের ক্ষেত্রেও। এই হিসাবেই কারও সারাদিনে লাগে ১২০০ ক্যালরি, কারও আবার ২০০০ ক্যালরি বা তার বেশি। এখন, শুধু ক্যালরি অলা খাবার খেলে হবে না। দেখতে হবে সারাদিনে তা যেন ব্যাংকের মতো অল্প অল্প করে গ্লুকোজ সরবরাহ করে। অর্থাৎ কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খেতে হবে। এতে সারাদিনে শরীরে কাজ করার ক্ষমতা থাকবে সমান। তাই রোগীর খাদ্য সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার, এতে সে নিজেই বুঝতে পারবে, তার কী খাওয়া দরকার আর কী নয়।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য কীভাবে বাছবেন:
পরিমাণ মতো শাকসবজি ও ফল খাবেন। বেশিরভাগ শাকসবজিতেই কার্বোহাইড্রেট থাকে। তবে তাদের মধ্যে ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবার জাতীয় উপাদান অনেক বেশি থাকায় সেগুলি বেছে নেওয়া খুব উপকারী প্রমাণিত হয়। খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার কমাতে হবে। ক্যানবন্দি খাদ্য খাওয়া বন্ধ করুন। দুধের মধ্যে টোনড মিল্ক খান। প্রতিদিন রান্নায় মাথাপিছু ৩ চা- চামচের বেশি তেল ব্যবহার করা যাবে না। দীর্ঘক্ষণ উপোস করে থাকবেন না। তিন-চার ঘন্টা অন্তর খাদ্যগ্রহণ করবেন।
এমন খাবার খান যেটিতে ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকবে। ‘ডায়েট চকোলেট’, মিষ্টি খেয়ে লাভ নেই। ক্যালরি খুব কম থাকে না ওগুলিতে। তাই মিষ্টি খেতে হলে, একটি খান ১৫ দিন অন্তর। মনে রাখবেন, সুগার হওয়ার পর, আপনি নিজেই নিজের ডাক্তার। আর সবাই জানে, ডাক্তার কখনই শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক এমন খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দেন না।