পাকস্থলীতে (Stomach)আলসার কেন হয় ?এর প্রতিকারই বা কি ?

অম্ল এবং পেপসিন নামক উৎসেচকের কারসাজিতে পাকস্থলীর মধ্যেকার আবরণীর মধ্যে ঘা তৈরি হয়। একেই বলে গ্যাসট্রিক আলসার। অম্ল বা অ্যাসিড এবং পেপসিনের যোগসাজশে ক্ষুদ্রান্ত্র ও পাকস্থলীতে একই প্রক্রিয়ায় আলসার হয়।

কীভাবে হয় আলসার ?

আমাদের পাকস্থলীতে সারাদিনে এক থেকে দেড় লিটার হাইড্রোক্লোরিক (এইচ সি এল) নামক অম্ল ক্ষরিত হয়। গত একশো বছর ধরে ধারণা ছিল পাকস্থলীর মধ্যস্থিত অম্ল মিশ্রিত জারক রসের পি এইচ (PH) ১.৫ থেকে ২। কিন্তু গত দশ বছর আগে জানা গিয়েছে এই জারক রসের অম্লতা ও তীব্রতা সর্বত্র সমান নয়। পাকস্থলীর মধ্যেকার ও নীচের অংশের পি এইচ ২ থেকে ২.৫। এবং সর্বোচ্চ স্তরের পি এইচ ১.৩ থেকে ১.৫। এই অ্যাসিডের বিভিন্ন অংশের তীব্রতার তারতম্য গ্যাসট্রিক আলসার তৈরিতে বড় ভূমিকা নেয়। নিরাপত্তার কারণেই পাকস্থলীতে অম্ল নিঃসরণের ব্যবস্থা করেছে প্রকৃতি। এই অম্ল খাদ্য পরিপাকে সহায়ক হয় এবং খাদ্যের সঙ্গে যেসব জীবাণু শরীরে প্রবেশ করছে তাও নষ্ট করতে সাহায্য করে। তাই প্রকৃতি পাকস্থলীর আবরণীতে বেশ কিছু প্রাকৃতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। যেমন, পাকস্থলীর আবরণী কোষগুলি অন্য অংশের তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠভাবে সন্নিবিষ্ট (টাইট সেল জাংশন)। এই কোষগুলির ওপর পাতলা একটি ক্ষারকের (অ্যালকালি) স্তর থাকে। এই অ্যালকালি স্তরটি অ্যাসিডকে কোষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থেকে দূরে রাখে। এছাড়া পাকস্থলীর আবরণী কোষের বিভাজনের হার খুব দ্রুত হওয়ায় ছোটখাট কোনও আঘাত বা ঘা খুব দ্রুত সেরে যায়। অর্থাৎ এইসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে গেলে তবেই পাকস্থলীতে আলসার বা ঘা হতে পারে।

কেন হয়-

আমাদের দেশে অ্যাসপিরিন ও ব্যথার ওষুধ বহুল প্রচলিত। এই দু’ধরনের ওষুধও পাকস্থলীতে ঘা হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। এই ওষুধগুলি পাকস্থলীর নিরাপত্তা বলয়কে আক্রমণ করে আবরণীতে ছিদ্র বা ঘায়ের সৃষ্টি করে।

মুশকিল হল, গত কয়েক দশকে হৃদয় সম্পর্কে মানুষ অত্যন্ত বেশি পরিমাণে অসচেতন হয়ে পড়েছেন। হার্ট ডিজিজের সমস্যা বেড়েই চলেছে ক্রমশ। ফলে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের হার গত দশ বছরে বহুলাংশে বেড়েছে। এছাড়া বেড়েছে নিজের ইচ্ছায় ওযুধের দোকান থেকে ব্যথা ও জ্বরের ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা। নিজের শরীর সম্পর্কে অজ্ঞতাজনিত অতিসচেতনতার ফলে নিজেরাই নিজেদের উপহার দিচ্ছি গ্যাসট্রিক আলসার নামক রোগটিকে। এছাড়া দীর্ঘদিন আয়রন ট্যাবলেট, পটাশিয়াম সিরাপ, ক্যানসারের কিছু ওষুধ, কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক (ম্যাক্সোলাইট গ্রুপের ওষুধ) ব্যবহারের ফলেও গ্যাসট্রিক আলসার হওয়ার আশঙ্কা থাক। লাল লংকার গুঁড়ো, মদ্যপান এবং ধূমপানও গ্যাসট্রিক আলসারের অবশ্যই আর একটি কারণ বলে জানা গিয়েছে এবং এটি প্রমাণিত সত্য। কিডনি ফেলিওর রোগীদের গ্যাসট্রিক আলসার হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট বেশি মাত্রায় থাকে। শরীরে ইউরিয়া বেড়ে যাওয়ার ফলে পাকস্থলীর স্বাভাবিক নিরাপত্তা বলয় নষ্ট হয়ে যায়। তাই আলসার নিরোধক চিকিৎসা অবশ্যই চালিয়ে যাবেন। আলসার নিরোধক ওযুধগুলির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে।

বিভিন্ন ধরনের প্রদাহের কারণেও পাকস্থলীতে আলসার হতে পারে। কিছু ভাইরাস, ছত্রাক জাতীয় সংক্রমণ পাকস্থলীতে প্রদাহ তৈরি করে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে এই প্রদাহ পরবর্তীকালে গ্যাসট্রিক আলসারে পরিণত হয়। আই সি সি ইউতে মারাত্মকভাবে অন্য অঙ্গের সংক্রমণজনিত কারণে ভরতি রোগীর পাকস্থলীতেও আলসার হতে পারে। এবার আসা যাক পাকস্থলীর আলসারের বড় এবং মুখ্য কারণটিতে। ১৯৮৩ সালে ডাঃ মার্শাল ও ডাঃ ওয়ারেন পাকস্থলীতে একটি জীবাণুর সন্ধান পান। তাঁরা গবেষণা করে এই জীবাণুটির সঙ্গে আলসারের যোগসূত্র আবিষ্কার করেন। প্রথমে তাঁরা এর নাম দেন ক্যাম্পাইলো ব্যাকটর পাইলোরি ডিশ। ১৯৮৯ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হেলিকো ব্যাকটর পাইলোরি। ভারতে গ্যাসট্রিক আলসারে আক্রান্ত হওয়া ৭৫ শতাংশ রোগীর শরীর থেকে এই জীবাণুর সন্ধান পাওয়া যায়।এইচ পাইলোরি তার cag A  ও vac A নামক বিষাক্ত পদার্থের সাহায্যে পাকস্থলীর আবরণীতে আলসারের সৃষ্টি করে।

রোগ পরীক্ষা-

শরীরে এই জীবাণুটির উপস্থিতি এমনিতে ধরা খুবই মুশকিল। কারণ কোনও পরীক্ষাগারের পরীক্ষাতে এরা সরাসরি ধরা দেয় না। কিন্তু এরা নিজেদের শ্বাসপ্রশ্বাস ও বেঁচে থাকার ফলশ্রুতি হিসেবে প্রচুর পরিমাণে ইউরিয়েস নামক উৎসেচক নিঃসরণ করে। র‍্যাপিড ইউরিয়েস টেস্ট (RUT)-এর মাধ্যমে এই উৎসেচটি খুব সহজেই ধরা পড়ে।

এইচ পাইলোরি সংক্রমণ প্রথমেই খুব বড় ধরনের উপসর্গের জন্ম দেয় না। কিন্তু ধীরে ধীরে এরা পাকস্থলীর আবরণীর মধ্যে সংখ্যা বৃদ্ধি করে সেখানে ঘায়ের সৃষ্টি করে। মূলত শিশু বয়েসেই দূষিত জলের মাধ্যমে এই জীবাণুটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। তাই জল সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং বারে বারে বিশেষত খাওয়ার আগে হাত ধোওয়া অবশ্য কর্তব্য।

চিকিৎসা-

এই জীবাণুটিকে তাড়াবার জন্য সম্মিলিতভাবে তিনটি ওষুধ দশ থেকে চোদ্দোদিন খেতে হয়। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই ওষুধগুলি খুব ভালো কাজ করে। রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যান।

রোগ প্রতিরোধ-

আমাদের কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে অনিয়মিত হয়েছে খাদ্যাভ্যাস। কী খাওয়া হল তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে কখন খাচ্ছেন!

বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর হালকা খাওয়ার (কম তেল ও মশলা যুক্ত) যেমন বিস্কুট, মুড়ি, কুকিজ, টোস্ট, শসা, পেয়ারা, তরমুজ খেলে আলসার হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট কমে যায়। যাঁদের আলসার বা প্রদাহের ইতিহাস আছে তাঁদের ক্ষেত্রে উপবাস সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

মনে রাখবেন বাইরের খাবার, তেল মশলা যুক্ত জাঙ্ক ফুড অনিয়মিত ও অতিরিক্ত অম্ল নিঃসরণ করিয়ে গ্যাসট্রিক আলসারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। কীভাবে বুঝবেন আপনার আলসার হয়েছে-

১) ক্ষুধামান্দ্য, খুব অল্প খেলেই পেট ভরে যাবে।

২) খাওয়ার আগে ও পরে পেট ফুলে থাকবে।

৩) পেটের উপরিভাগের মধ্যস্থলে জ্বালা অথবা যন্ত্রণা।

৪) খাওয়ার পর ওই স্থানে ব্যথা আরও বাড়বে।

৫) বমি, বমি ভাব, সকালের দিকে বেশি অনুভূত হবে কখনও বমি হতেও পারে।

৬) কখনও রাতের দিকে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৭) কোনও কোনও সময় রক্তবমি হওয়াও সম্ভব।