আয়ুর্বেদের বিখ্যাত গ্রন্থ চরক সংহিতায় চিকিৎসা স্থানের ত্রিশতম অধ্যায়ে বিভিন্ন স্ত্রী রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের শরীর স্থানে গর্ভাবস্থা এবং সন্তান জন্মের পরে বিভিন্ন সমস্যার কথা আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া আয়ুর্বেদের বিভিন্ন গ্রন্থে ত্বক, কেশ এবং অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে ফলদায়ক চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে, যা মহিলাদের জন্য ভীষণ জরুরী।
ডিসফাংশনাল ইউটেরাইন ব্রিডিং এবং মেনোরেজিয়া: এই সমস্যায় যজ্ঞডুমুর
অত্যন্ত উপকারী ভেষজ। চিনি দিয়ে এই ফলের রস খেলে খুব ভালো ফল হয়। এর সঙ্গে নিয়মিত দুধ ও দুধজাত দ্রব্য পথ্য হিসেবে খেতে হবে। বাসকের রস পানেও উপকার হয়। ব্যথা ও জ্বালাভাব থাকলে গুলঞ্চ তঅথবা আমলকীর রস পান করতে হবে। অলোকারিষ্ট, লোৱাসব এবং প্রদরান্তক লৌহ এই রোগের ঔষধ।
লিউকোরিয়া: মধু মিশ্রিত আমলকী চূর্ণ ব্যবহারে উপকার হয়। পুষ্যানুগ চূর্ণ, পত্রাঙ্গাসব, চন্দ্রপ্রভা বটী ব্যবহার করলে এই সমস্যা নির্মূল হয়। ধনেবীজ জলে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে ওই কাথ পান উপকারী। ডায়েটে ঢেঁড়শ রাখলে উপকার পাওয়া যাবে।
ডিসমেনোরিয়া: অশোক, শতাবরী, কৃষ্ণতিল, হরিতকী, মৌরী, জটামাংসী প্রভৃতি ভেষজ এই রোগে উপকারী। প্রতিদিন রশুন দুধে মিশিয়ে খেলে উপকার হয়। চন্দনাদি চূর্ণ এবং প্রদরারি লৌহ ফলদায়ক ঔষধ।
মেনোপজাল প্রবলেমস: সুষম খাদ্য গ্রহণ পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান এবং নিয়মিত এক্সারসাইজ করা দরকার। সোয়াবিন জাত খাদ্য ব্যবহারে উপকার হয় কারণ এতে আছে মৌরী, ফাইটোট্রাজেন, জিরে, হলুদ, শুঁঠ, মরিচ প্রভৃতি ভেষজ উপকার করে।
ইউটেরাইন প্রোল্যান্স: এই সমস্যায় নিম্নোক্ত যেকোন একটি প্রলেপ ব্যবহার করা যেতে পারে-
• পলাশফুল, যজ্ঞডুমুর, তিলতৈল ও মধুর মিশ্রণ।
• তঅশ্বগন্ধা, বচ, হলুদ, কড়, মরিচ- এর মিশ্রণ।
• মদনফল, মধু ও কপূরের মিশ্রণ।
রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া: সবুজ শাক সবজি, প্রোটিন জাত খাদ্য, ড্রাই ফ্রুট, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। মেথি ও মৌরী উপকারী। নবায়স লৌহ, পুনর্ণ বা মন্ডুর অত্যন্ত উপকারী। গুড় ও হরিতকী চূর্ণ সেবনে উপকার হয়। হলুদ, ত্রিফলা এবং বহেড়া প্রয়োগে ভালো ফল হয়।
অতিরিক্ত ওজন: ত্রিফলা চূর্ণ, নবকগুগ্রুল, ক্রযণাদ্যগুগুল, লৌহর সায়ন, অমৃতাদি গুপ্তল প্রভৃতি সেবনে উপকার হয়। উষ্ণ জলে লেবুর রস ও মরিচ চূর্ণ মিশিয়ে পান করলে উপকার হয়। সষ্টিমধু, শুঁঠ, ব্রাহ্মী, অ্যালোভেরা, মুথা, গুলঞ্চ প্রভৃতি ভেষজ ব্যবহার করা যেতে পারে।
কেশ সমস্যা: নিয়মিত সষ্টিমধু ও আমলকী সেবনে উপকার হয়। এতে চুল পড়া বন্ধ হয়। অ্যালোভেরা, ভুঙ্গরাজ, মেথি প্রভৃতি চুলের জন্য উপকারী। খুশকির সমস্যায় নিম ব্যবহার করলে ভালো ফল হয়। নিমের কাথ দিয়ে হেয়ার ওয়াশ করলে ছত্রাক সংক্রমণ কমে। মাথায় ধুতুরা পাতা বেটে প্রলেপ দিলে উকুন নাশ হয়। বিশুদ্ধ নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল লাগালে চুলের বৃদ্ধি ভালো হয়। সুষম আহার এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম কেশ চর্চা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দেহে ভিটামিন এবং মিনারেলের অভাব চুল পড়ার সমস্যার অন্যতম কারণ।
অনুজ্জ্বল ত্বক: কমলা লেবুর রস ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। ত্বকের দাগ ছোপ বিশেষ করে ব্ল্যাক হেডস ও মেচেতা দূর করতে মুসুর ডাল পেস্ট করে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে লাগাতে হবে। মরসুমি ফল অথবা ফলের রস ত্বকের জন্য ভীষণ ভালো। চকচকে ত্বকের জন্য জায়ফলের প্রলেপ, রক্তচন্দন, মঞ্জিষ্ঠা লোয়, প্রিয়ঙ্গু ও বটাঙ্কুরে প্রলেপ খুবই উপকারী। পিম্পলসের সমস্যায় শিমূলের কাঁটা জলে বেটে প্রলেপ দিতে হবে। যব, লৌধ, যষ্টিমধু চূর্ণের প্রলেপ দিলে ত্বক উজ্জ্বল হয়। রক্তচন্দন, দারুহরিদ্রা, হরিদ্রা, মঞ্জিষ্ঠা, কেশর দুধের সঙ্গে মিশিয়ে মুখে লাগালে মুখের কালোভাব দূর হয়।
গায়ে দুর্গন্ধ: স্নানের জলে কপূর, নিম ও তুলসী পাতা ব্যবহার করলে উপকার হয়। এছাড়া খস বা বেনামূল ব্যবহার করা যায়।
অস্টিও আর্থরাইটিস এবং অস্টিও পোরোসিস: যদি দেহের ওজন বেশি হয় তবে প্রথমেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গুগুল জাতীয় ওষুধ যেমন যোগরাজ গুগুল, লাক্ষাদি গুম্বুল, ত্রিফলা গুম্বুল প্রভৃতি সেবনে উপকার হয়। বেদনা ও ফোলা ভাব কমানোর জন্য হলুদ, অশ্বগন্ধা, আদা, রসুন, প্রভৃতি ভেষজ ব্যবহার করা যেতে পারে। মুক্ত ও প্রবাল পিষ্টি এবং শঙ্খ-শুক্তি-বরাটিকা ঘটিত ওষুধ অস্টিওপোরোসিসে ভালো কাজ করে। এক কাপ গরম সরষের তেলে দু’চামচ কপূর মেশাতে হবে। এরপর কম আঁচে বেশ কিছুক্ষণ রেখে কপূর গলিয়ে নিতে হবে।
আক্রান্ত স্থানে এই তেল লাগালে পেন রিলিফ হবেই। সমস্তরকম ঠান্ডা পানীয় ও খাবার বর্জন করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সহজপাচ্য খাবার খাওয়া দরকার।
দেহে ক্যালশিয়ামের অভাব ঘটলে বাইরে থেকে ক্যালশিয়াম সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে।
কিছু জরুরী কথা
• সুষম আহার এবং পর্যাপ্ত ঘুম ভীষণ জরুরী।
• মানসিক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চলাই ভালো।
• ত্রিফলা, হলুদ, নিম, তুলসী, যষ্টিমধু প্রভৃতি ভেষজ ত্বক ও কেশের জন্য খুবই ভালো।
• নিয়মিত এক্সারসাইজ করা দরকার।
• বয়সের ছাপ এবং বলিরেখা কমাতে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও সবজি খেতে হবে।
• বচ, ব্রাহ্মী, গুলঞ্চ, শঙ্খপুষ্পী, যষ্টিমধু, আমলকী প্রভৃতি ভেষজ রসায়ন গুণ সম্পন্ন হওয়ায় সমস্ত রোগের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি করে।