কোলেস্টেরল আসলে কী
কোলেস্টেরল হল মোমের মত চর্বি জাতীয় পদার্থ, যা ১৭৬৯ সালে মানুষের গলস্টন থেকে ফ্রাঙ্কোস পউলেতিয়ার ডে লা স্যালে আবিষ্কার করেন। যদিও ১৮১৫ সাল পর্যন্ত এই মোমজাতীয় পদার্থের কোনওরকম নামকরণ করা হয়নি। মাইকেল ইগুয়িন শেভরুয়াল এই মোমজাতীয় পদার্থের নাম দেন কোলেস্টেরিন।
কোলেস্টেরল নানাভাবে আমাদের শরীরের গঠনে সাহায্য করে। তবে সমস্যাটা শুরু হয় তখনই, যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল আমাদের শরীরে তৈরি হয়। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, কোলেস্টেরলকে তিনভাগে ভাগ করা যায়, যথা এইচ ডি এল, এল ডি এল এবং ভি এল ডি এল।
এল ডি এল হল খারাপ কোলেস্টেরল যা শরীরের পক্ষে খুবই খারাপ। অন্যদিকে এইচ ডি এল হল ভালো কোলেস্টেরল। এটি শরীরের পক্ষে খুব ভালো।
রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বাড়তে থাকলেই সমস্যা হতে শুরু করে। বিশেষ করে হার্টের প্রধান ধমনিতে কোলেস্টেরল জমা হয়ে দেখা দেয় হার্ট অ্যাটাক। এখন প্রশ্ন একজন মানুষের শরীরে ঠিক কতটা কোলেস্টেরল থাকা দরকার?
প্রতি ডেসিলিটার রক্তে টোটাল কোলেস্টেরলের পরিমাণ ২০০ মিলিগ্রামের কম থাকলে করোনারি হার্ট ডিজিজের আশঙ্কা কমে। তবে তা যদি ১০০ থেকে ২৩৯ মিলিগ্রাম হয়, তাহলে এখন থেকেই সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে। আর যদি প্রতি ডেসিলিটার রক্তে টোটাল কোলেস্টেরলের পরিমাণ কারও ২৪০ মিলিগ্রাম বা তার ওপরে হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা সুস্থ সাধারণ মানুষের থেকে দ্বিগুণ হয়। এক্ষেত্রে জেনে রাখা প্রয়োজন যে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে এল ডি এল ১০০ মিলিগ্রামের নিচে থাকলে তা অনুকূল অবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রসঙ্গত, প্রতি ডেসিলিটার রক্তে এইচ ডি এল ৬০ মিলিগ্রাম বা তার ওপরে থাকলে তা খুবই স্বাস্থ্যকর। আর যদি এই মাত্রা ৪০ থেকে ৬০ মিলিগ্রামের মধ্যে থাকে তাহলে তা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।
হাই কোলেস্টেরলের লক্ষণ
রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলেও কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায় না। আশঙ্কার কথা হল, প্রথম লক্ষণ হিসাবেই দেখা দেয় হার্ট অ্যাটাক। তাই ২০ বছর বয়সের পর, প্রতি তিন বা পাঁচ বছর অন্তর রক্তে কোলেস্টেরল কতটা আছে তা চেক করান।
আর ৪০ বছরের পর থেকে তো প্রতি ছ’মাস অন্তর রক্তে কোলেস্টরলের পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
তবে কিছু কিছু লোকের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়লে চোখের পাতায় কোলেস্টরল জমা হওয়ার দাগ দেখা যায়। এইরকম হলেই সতর্ক হন।
ডায়েট কেমন হবে
রেড মিট, প্রাণীর মেটে, ফুল ফ্যাটযুক্ত গোরুর দুধ, মিষ্টি, চিজ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আইস ক্রিম, বাটার, কুসুমশুদ্ধ ডিম সেদ্ধ (সপ্তাহে চারটের বেশি), ওমলেট, পট্যাটো চিপস, তেলে ভাজা মাংস, পিনাট বাটার, মাফিন, পাম অয়েল, নারকেল তেল, যেকোনও রকম টিনজাত খাদ্য, প্রচুর পরিমাণে ভাত, আলু খাওয়ার অভ্যেস রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। তাই এইসব খাবার না খাওয়াই ভালো।
কী করবেন
• প্রতিদিন ৪০ মিনিট ঘাম ঝরিয়ে হাঁটুন। হাঁটতে না পারলে বাড়ির কাজ করুন ছোট মাছ খান। রেড মিট জাতীয় মাংস খাওয়া যতটা সম্ভব কম করুন ভাজা খাওয়া কমিয়ে সেদ্ধ বা ভাপা খাওয়া অভ্যেস করুন • চর্বিহীন মাংস খান প্রচুর শাকসবজি খান ধূমপান ত্যাগ করুন অ্যালকোহল পান করা কমান উচ্চতার অনুপাতে ওজন বেশি থাকলে এখনই কমান।
কোলেস্টেরল কমাতে হোমিওপ্যাথি ওষুধ
প্রচুর হোমিওপ্যাথি ওষুধ আছে যেগুলি রক্তে এল ডি এল কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে খুবই ভালো কাজ দেয়। সেই সঙ্গে ধমনিতে কোলেস্টেরল ডিপোজিট কমাতেও সাহায্য করে।
যেমনটা সকলেরই জানা যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তাই কোলেস্টেরলের চিকিৎসায় সবাইকে যে একই ওষুধ দেওয়া হবে, এমন নয় কিন্তু! এই রোগে ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা আলাদা ওষুধ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
• অ্যালিয়াম স্যাটিভাম (Allium Sativum): কোলেস্টেরল কমাতে সবথেকে কার্যকরী ওষুধ হল এটি।
• অরাম মেটালিকাম (Aurum
Metallicum): কোলেস্টেরল বৃদ্ধির সঙ্গে যাদের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে ওঠানামা করে এবং শরীরে অস্বস্তি ভাব থাকে, তাদের এই ওষুধটি দেওয়া হয়।
• ক্যালকেরিয়া কার্বোনিকা (Calcarea
Carbonica): মাত্রাতিরিক্ত ওজন, সেই সঙ্গে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ হাই থাকলে এই ওষুধটি দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না।
• নাক্স ভমিকা (Nux Vomica): রোগীর মদ্যপানের কুঅভ্যাস আছে, আবার রেড মিটেরও ভক্ত! তাহলে এই ওষুধটির কোনও বিকল্প নেই। অ্যালিয়াম স্যাটিভা এবং নাক্স ভমিকাই কোলেস্টেরলের চিকিৎসায় সবথেকে বেশি ব্যবহৃত ওষুধ।
• ক্র্যাটিগাস অক্সিয়াকেস্থা (Crataegus Oxyacntha): ধমনিতে চর্বি জমে যখন হার্টে রক্ত সরবরাহ কমে যায়, তখন হৃদযন্ত্রের পেশি দুর্বল হতে শুরু করে। এই সমস্যায় এটি দারুন কাজ দেয়।
• ব্যারিটা মিউরিটিকাম (Baryta
Muriaticum): বয়স্ক মানুষেরা একসঙ্গে হাই কোলেস্টেরল এবং হাই প্রেসারে আক্রান্ত হলে দেওয়া হয় এই ওষুধটি।
• স্ট্রুফান্থাস হিসপিডাস (Strophanthus Hispidus): খারাপ কোলেস্টেরল বা এল
ডি এল-এর খারাপ প্রভাব কমাতে এবং হার্টের পেশির দুর্বলতা দূর করতে এই ওষুধটি দেওয়া হয়।
• কারকিউমা (Curcuma): শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা খারাপ কোলেস্টেরল শরীর থেকে বের করতে সাহায্য করে এই ওষুধ।
• ফেল টাউরি (Fel tauri):
কোলেস্টেরলের চিকিৎসায় তো বটেই লিভারের দুর্বলতা দূর করতেও এই ওষুধটি ব্যবহার করা হয়।
• চেলিডোনিয়াম (chelidonium):
যকৃত এবং লিভারের নানা রোগে এই ওষুধটির উপর ভরসা করতে পারেন, বেশ কার্যকরী।
• কোলেস্টেরিনাম এবং কার্ডয়াস মেরিয়ানাস (Cholesterinum & Carduus Marianus): ধমনীর দেওয়ালের ক্ষয় রোধে এই ওষুধটি দেওয়া হয়।
• ইউরেনিয়াম নিট্রিকাম (Uranium Nitricum): কোলেস্টেরলের সঙ্গে যদি রোগীর ডায়াবেটিসও থাকে তাহলে এই ওষুধটি দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়।
• সোরিনাম (Psorinum): শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে কাজে লাগে এই ওষুধটি।
একনজরে-
• প্রতি ডেসিলিটার রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি হলে তাকে বলে হাইপার কোলেস্টেরলেমিয়া রক্তে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরলের উপস্থিতি হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া অ্যাঞ্জাইনার মতো উপসর্গও উচ্চ কোলেস্টেরলের প্রভাবে দেখা দিতে পারে
• রক্তে খারাপ কোলেস্টরলের উপস্থিতি যে কোনও বয়সের মানুষের জন্যই দরকার, তা সে কমবয়সি, মধ্যবয়সি বা বৃদ্ধবয়সি যাই হন না কেন কোলেস্টেরল হল চর্বির মত উপাদান যা আমাদের দেহে তৈরি হয়।
আবার কিছু কিছু খাদ্যেও কোলেস্টেরল থাকে। বিশেষ করে শর্করাজাতীয় খাদ্য থেকে শরীরে বেশি পরিমাণ কোলেস্টেরল ঢোকে বলে জানা গিয়েছে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে রক্তে কোলেস্টরল বাড়লেই তা জমা হয় আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধমনিতে। ধীরে ধীরে ধমনি সরু হতে থাকে। এভাবেই বেড়ে যায় রক্তচাপের আশঙ্কা। বাড়ে স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকেরও আশঙ্কা আশঙ্কার কথা হল, রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ার সেভাবে কোনও লক্ষণ থাকে না। ফলে বেশিরভাগ মানুষ জানতেও পারে না তাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। তাই ৪০ পেরনোর পর পর প্রত্যেকের উচিত ছ’মাস অন্তর লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করানো। ২০ বছর বয়সের পর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একবার করানো উচিত এই পরীক্ষা। সাধারণত ৯-১২ ঘন্টা উপোস করে তারপর এই রক্ত পরীক্ষা করাতে হয় খাদ্যে শর্করার পরিমাণ কমান। পরিবর্তে ফল খান। এক্সারসাইজ করুন। এক্সারসাইজ কোলেস্টেরল কমাতে খুব ভালো ফল দেয়।