মাথাব্যথার সমস্যাকে আমরা মূলত মা দুটিভাগে ভাগ করি। প্রথমত, একধরনের মাথাব্যথা হয়, যার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। একে বলে প্রাইমারি হেডেক। দ্বিতীয়ত, সেকেন্ডারি হেডেক। এই ধরনের মাথাব্যথা হওয়ার কিছু নির্দিষ্ট কিছু কারণ থাকে।
প্রাইমারি বা প্রাথমিক মাথাব্যথা-
এই ধরনের মাথা ব্যথার মধ্যে পড়ে ক্লাস্টার হেডেক, টেনশন হেডেক, মাইগ্রেন।
মাইগ্রেন: প্রথমে মাইগ্রেন নিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যাক। মাইগ্রেনের কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে। প্রথমত এই অসুখে মাথার যন্ত্রণা বেশ কয়েকদিন অন্তর ফিরে আসে। মাইগ্রেনের যন্ত্রণা মাথার যে কোনও একদিক থেকে শুরু হয়। ধীরে ধীরে পুরো মাথা জুড়েই ব্যথা ছড়িয়ে যায়। রোগী বলেন মাথা দপদপ করছে। কেউ মাথা টিপে দিলেও রোগীর বিশেষ আরাম হয় না। ব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব থাকতে পারে। এমনকী কারও কারও বমিও হয়। তবে বমি হওয়ার পরেও মাথাব্যথা কমে না। এছাড়া অন্ধকারে থাকতে ইচ্ছে করে রোগীর। কারও সঙ্গে কথা বলতে বা কাজ করতে ইচ্ছে করে না। মারাত্মক বিরক্তি ভাব দেখা যায় ব্যথায় ভোগা মানুষটির মধ্যে। খোঁজ নিলে দেখা যায় রোগীর পরিবারে অন্য সদস্যও মাইগ্রেনে আক্রান্ত ছিলেন বা আছেন। ছ’সপ্তাহের বেশি এইরকমভাবে ব্যথা হলে ও রোগ পরীক্ষায় অন্য কোনও ধরনের স্নায়ুগত সমস্যা ধরা না পড়লে ওই ব্যথাকে মাইগ্রেন ধরে নেওয়া যেতে পারে। রোগীবিশেষে যন্ত্রণার অনুভূতি ৪ থেকে ৭২ ঘন্টা অবদি স্থায়ী হতে পারে।
দেখা গিয়েছে, পঞ্চাশোর্ধদের নতুন করে মাইগ্রেন শুরু হয় না। সাধারণত তরুণ- তরুণীরা মাইগ্রেনের ব্যথায় আক্রান্ত হন বেশি। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। শিশুরাও মাইগ্রেনে আক্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে মাইগ্রেনের সঙ্গে পেটব্যথার উপসর্গ থাকে।
মাইগ্রেনের প্রকারভেদ
মাইগ্রেন সাধারণত দু’ধরনের হয়।আলোর আভাযুক্ত মাইগ্রেন ও আলোর আভাহীন মাইগ্রেন। প্রথমটির ক্ষেত্রে রোগী মাথা ব্যথা শুরু হওয়ার আগে চোখে আলোর ঝলকানির মতো বেখতে পান। চোখের সামনে থাকা বস্তু কম্পিত হচ্ছে বলে মনে হয়। আলোর আভাহীন মাইগ্রেনে রোগী এইরিকম কোনও আলো দেখতে পান না। তবে মাথা ভার ভার লাগতে শুরু করলেই রোগী বুঝতে পারেন, মাইগ্রেন অ্যাটাক শুরু হয়েছে।
আরও একটি মাইগ্রেন অ্যাটাক নিয়ে কথা বলা দরকার। সেটি হল মেনস্ট্রুয়াল মাইগ্রেন। উপসর্গ সব একই। তবে এই মাইগ্রেনের বিশেষ দুটি ধরন আছে। প্রথমত মহিলাদের মেনস্ট্রুয়েশন শুরু হওয়ার পরেই মাইগ্রেনের অ্যাটাক হয়। অন্যসময় থাকে না। দ্বিতীয়ত, মেনস্ট্রুয়েশন শুর হওয়ার দিন কয়েক আগে বা পরে যন্ত্রণা শুরু হয়।
রোগনির্ণয়ক পরীক্ষা
সাধারণত উপসর্গ দেখেই চিকিৎসক বুঝতে পারেন রোগীর মাইগ্রেন থেকে মাথা ব্যথা হচ্ছে নাকি অন্য কোনও কারণে। তবে চিকিৎসক প্রয়োজন বুঝলে এমআরআই করাতে দিতে পারেন।
কেন হয় মাইগ্রেন
মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিকের সক্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে মাইগ্রেন অ্যাটাক শুরু হয়। এছাড়া জিনগত কারণ রয়েছে। মাইগ্রেন অ্যাটাক বাড়ার কারণ
দেখা গিয়েছে বেশি দুশ্চিন্তা করলে, চিজ, বাটার, পনির, কফি, চকোলেট, আজিনামোতো দেওয়া খাদ্যগ্রহণ করলে, দীর্ঘসময় পেট খালি রাখলে ঘনঘন মাইগ্রেন অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এছাড়া প্রচণ্ড রোদে বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় দীর্ঘসময় থাকলে মাইগ্রেন অ্যাটাক বাড়ে। ঘুম কম হলেও মাইগ্রেনের অ্যাটাক হতে পারে। নিয়মিত ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল খেলে
মাইগ্রেনের অ্যাটাক বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
কতদিন পরপর অ্যাটাক হচ্ছে সেটা মনে করে খাতায় লিখে রাখুন। যে যে জিনিস খেলে মাইগ্রেন অ্যাটাক বাড়ে সেগুলি এড়িয়ে চলুন। রোদে বেরতে হলে মাথায় ছাতা দিন। ঠান্ডায় গরম কাপড় ও কান- মাথা ঢাকা টুপি ব্যবহার করুন। দীর্ঘসময় পেট খালি রাখবেন না।
অ্যাটাক শুরু হওয়ার আগে রোগী বুঝতে পারেন। মাস দেড়েক- দুয়েকের অন্তরে মাইগ্রেনের ব্যথা ফিরে এলে, অ্যাটাক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যারাসিটামল খাওয়া চলতে পারে। এতে ব্যথা গুরুতর আকার ধারণ করে না। তবে ঘনঘন ব্যথা ফিরে এলে প্যারাসিটামল খাওয়া চলবে না। মুশকিল হল, বহু মানুষ বারবার এই ব্যথার কবলে পড়ে ঘনঘন ওষুধের দোকান থেকে বেদনানাশক ওষুধ খেতে শুরু করেন। ফলে পরবর্তীকালে চিকিৎসকের মাইগ্রেনের চিকিৎসা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই সময় থাকতে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। বহু ওষুধ আছে যেগুলি মাইগ্রেনের অ্যাটাক কমিয়ে দেয়।
টেনশন হেডেক: মারাত্মক দুশ্চিন্তা হলে মাথাব্যথার মতো লক্ষণ হতে পারে। সারাদিন অফিসে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হলে, পরীক্ষা নিয়ে টেনশন থাকলে, অস্বস্তিকর পরিবেশে কাজ করতে হলে, খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম হলে, দীর্ঘসময় কম্পিউটারে সামনে বসে থাকতে হলে এইধরনের মাথাব্যথার শিকার হতে হয়। চিকিৎসা বলতে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। তবে মাস দেড়েক অন্তর এমন হলে এইভাবে নিজের থেকে প্যারাসিটামল খাওয়া চলতে পারে। বারবার এমন হলে অবহেলাও করা যাবে না। তখন দেখতে হবে মাথাব্যথা হওয়ার পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে কি না।
ক্লাস্টার হেডেক: সাধারণত কমবয়সি ছেলেমেয়েরা এই ধরনের মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। তবে খুব মানুষই এই সমস্যায় পড়েন। এই রোগের বিশেষত্ব হল, দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার এই ধরনের মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হন রোগী। চোখ এবং চোখের চারধারে ব্যথা হয়। চোখ লাল হয়ে যেতে পারে, এমনকী জলও পড়তে পারে। সেকেন্ডারি হেডেক- এক্ষেত্রে বাহ্যিক কোনও কারণ নয়। ব্যথার উৎস থাকে মস্তিস্কের অন্দরে। ব্রেনের অন্দরে রক্তক্ষরণ, ব্রেন টিউমার, মেনিনজাইটিস, এনকেফেলাইটিসের মতো মারাত্মক সংক্রমণে তীব্র মাথার যন্ত্রণা হয়। এছাড়াও সেরিব্রাল ভেনাস থ্রম্বোসিসের কারণে মাথায় তীব্র ব্যথা হয় (রক্তবাহী নালিতে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হওয়া)। সাইনুসাইটিসের সমস্যা থেকেও মাথায় তীব্র ব্যথা হয়। এই সমস্যাগুলি ছোটবড় সকলেরই হতে পারে।
মেনিনজাইটিস: জ্বর, বমি, ঘাড় শক্ত হওয়ার মতো অনুভূতি এবং সঙ্গে তীব্র মাথার যন্ত্রণা হল মেনিনজাইটিসের লক্ষণ। মেনিনজাইটিস ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ- উভয় কারণেই হতে পারে। মস্তিক এবং স্পাইনাল কর্ডের আবরণী আক্রান্ত হয় এই রোগে।
এনকেফেলাইটিস: মশাবাহিত এই রোগে এনকেফেলাইটিস ভাইরাস মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলিকে আক্রমণ করে। অসুখের প্রধান লক্ষণ হল রোগী দীর্ঘদিন যাবৎ জ্বরে ভোগেন। সঙ্গে থাকে তীব্র মাথাব্যথার মতো উপসর্গ। ব্রেন টিউমার: প্রধান লক্ষণ হল প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। এই ব্যথা ঘন ঘন হয়ে থাকে। সাধারণ বেদনানাশক ওষুধে ব্যথা কমে না। এছাড়া চলাফেরা করতে সমস্যা হওয়া, হাঁটার সময় মাথা ঘোরার মতোও সমস্যাও থাকতে পারে।
সেকেন্ডারি হেডেকের ক্ষেত্রে রোগ ধরার জন্য বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। ব্রেনের সিটি, এমআরআই এর সঙ্গে কিছু রক্ত পরীক্ষা এবং সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড টেস্ট করতে হতে পারে।
সাইনুসাইটিস: মুখমণ্ডলের হাড়ের ভিতরে কতগুলো ফাঁপা জায়গা আছে তাকে সাইনাস বলে। কোন কারণে যদি সাইনাসগুলির মধ্যে সংক্রমণ হলে তাকে সাইনুসাইটিস বলে। প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়। মাথা নীচু করলে ব্যথার তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে থাকে।
প্রাইমারি হোক বা সেকেন্ডারি, রোগী অনেক সময়েই বুঝতে পারেন না কেন মাথাব্যথা হচ্ছে। অনেকেই মাথাব্যথার সমস্যাকে অবহেলা করেন। তাই সময় থাকতে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। সাধারণত চিকিৎসকের কথা মতো অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে রোগ সেরে যায়।
মাথার ব্যথায় কখন প্রয়োজন চিকিৎসকের পরামর্শ-
কোনও দিন মাথাব্যথা ছিল না। অথচ হঠাৎই তিন চারদিন পরপরই মাথাব্যথা হচ্ছে। মোটামুটি সাত-আটদিনের মধ্যে বারদুয়েক এমন হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর শুরু থেকেই ব্যথার তীব্রতা খুব বেশি থাকলে, বমি হয় ও বমি হওয়ার পর ব্যথা কমে গেলে সেইদিনই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। রাতে ঘুমের মধ্যে মাথা ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেলে সতর্ক হন। আবার শরীরে ভঙ্গীমায় পরিবর্তন করলেই মাথায় যন্ত্রণা অনুভব করেন অনেকে। একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট। হবে বিষয়টা। ধরা যাক কেউ বামদিকে কাত হয়ে শুয়েছিলেন, ডানদিকে পাশ ফিরতেই ব্যথা হতে শুরু করল মাথায়- এমন হলে উপসর্গ এড়িয়ে যাবেন না। তাছাড়া মাথা ব্যথার সঙ্গে হাত-পা কাঁপা, চোখে দেখতে সমস্যা হলে সত্ত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর একটা কথা, খুব বেশি বয়সে হঠাৎ মাথাব্যথা শুরু হলেও তা হালকাভাবে নেবেন না।